সব কিছুরই একটা ‘প্রথমবার’ থাকে। ১ বছর বয়সের মধ্যে আপনার শিশু বেশ কিছু কাজ ‘প্রথমবার’ করবে। বাচ্চা প্রথম ১২ মাসে যেসব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মাইলফলক অর্জন করবে তা নিয়েই লেখাটি।
প্রতিটি শিশুই কোনো না কোনো বিষয়ে অন্য বাচ্চার চেয়ে আলাদা। আপনার শিশুর চোখের রঙ, হাসির ধরন যেমন অন্য সবার চেয়ে আলাদা, তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও নিজের গতিতেই চলে।
তাই বাচ্চাকে সমবয়সী অন্য বাচ্চার সাথে তুলনা করা ঠিক নয়।
কোনো শিশু খেলার মাঠে ছোটাছুটি করতে ভালোবাসে, কোনো বাচ্চা কথা বলা দ্রুত শিখে ফেলে। আবার দেখবেন কোনো বাচ্চা প্রত্যেকটা মাইলফলক নির্দিষ্ট সময়েই অর্জন করে ফেলছে, কিন্তু তার বয়সীই অন্য শিশুর তুলনামূলক বেশি সময় লাগছে।
তবুও, ১২ মাস বয়সের মধ্যে বাচ্চা নির্দিষ্ট কিছু মাইলফলক অর্জন করার আশা রাখতে পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোনো বিষয়ে খুব বেশি পিছিয়ে না থাকলে ১ বছর বয়সের এই মাইলফলকগুলো নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে একটু দেরিতে হলেও পূরণ হয়ে যায়।
১ বছর বয়সী শিশুর বিকাশের মাইলফলক
১ বছর বয়সী শিশুর চলাফেরার মাইলফলক (movement milestones)
শিশু যদি কোনো কিছু ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, অথবা দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো গুটিগুটি পায়ে হাঁটার চেষ্টা করে, বুঝে নিতে হবে আপনার আদরের টডলার প্রথম জন্মদিনের কাছাকাছি সময়েই নিজের মোটর স্কিলে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আমরা যে নড়াচড়া করি, হাঁটাচলা করি এই দক্ষতাকেই মোটর স্কিল বলা হয়।
নিজেই বসে থাকতে পারবে
শিশু ৪ থেকে ৫ মাস বয়সের মধ্যেই হেলান দিয়ে বসতে শিখে ফেলে। বয়স ১ বছরের কাছাকাছি হলেই হেলান দিয়ে বা কোনোকিছুর ওপর ভর না দিয়ে নিজেই উঠে বসে থাকতে পারবে।
হামাগুড়ি দিয়ে আগাতে পারবে
যদিও সব বাচ্চা হামাগুড়ি দেয় না, তবে পেটের ওপর ভর দিয়ে আগাতে পারাটা এ বয়সের শিশুরা শিখেই নেয়। এভাবে মোটর স্কিলে দক্ষ হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে বাচ্চা চার হাত-পায়ের ওপর ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শেখে।
নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারবে
ছোট চেয়ার বা টেবিলের ওপর ভর করে উঠে দাঁড়াতে পারলে বুঝতে হবে আপনার বাচ্চা খুব তাড়াতাড়ি ছোট ছোট পা ফেলতে পারবে৷ পুরোপুরি হাঁটা শেখার আগের পর্যায়ে শিশুরা এই মাইলফলক অর্জন করে ফেলে।
গুটি গুটি পা ফেলতে পারবে:
অনেক বাচ্চা দেখা যায় ১ বছর বয়সেই বড় কারো সাহায্য নিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে একটু হাঁটতে পারে। কিন্তু সাধারণত ১৮ মাস (দেড় বছর) বয়সের পরেই বেশিরভাগ শিশু নিজে নিজে হাঁটতে অভ্যস্ত হয়।
১ বছর বয়সী শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক মাইলফলক
১ বছর বয়সে এসে আপনার শিশু বেশ কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক মাইলফলক অর্জন করবে এই প্রত্যাশা রাখতে পারেন। এই পর্যায়ে এসে শিশু নতুন কিছু শেখা, সবকিছু খুটিয়ে দেখা, ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করা, চিন্তা করার দক্ষতা অর্জন করবে। এই মাইলফলকগুলোর মাধ্যমে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।
জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখবে
এ বয়সে বাচ্চা হাতের কাছে কিছু পেলেই নেড়েচেড়ে দেখতে চায় সেটা দিয়ে কী করা যায়। ১ বছর পূরণ হতে না হতেই খেয়াল করবেন আপনার ক্ষুদে বিজ্ঞানী ঘরের জিনিসপত্র নাড়িয়ে দেখছে, আছাড় দিচ্ছে, ছুঁড়ে মারছে।
লুকিয়ে রাখা জিনিস খুঁজে বের করতে পারবে
বাচ্চার বয়স যখন ১ বছরের কাছাকাছি হবে, তার পছন্দের খেলনাটা কাঁথার নিচে লুকিয়ে দেখুন- নিজেই খুঁজে বের করে ফেলবে।
জিনিসপত্র বাক্সে রাখতে পারবে
এ পর্যায়ে এসে বাচ্চা খেলনা জড়ো করে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখতে শেখে। আবার সেগুলো মাটিতে ছড়িয়ে ফেলতেও পারে। ধীরে ধীরে নড়াচড়ায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে এ ধরনের শব্দময় খেলায় বাচ্চা অনেক মজা পায়।
জিনিস ঠিকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করবে
প্রথম জন্মদিনের এগিয়ে এলেই দেখবেন বাচ্চা বিভিন্ন জিনিসের ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারছে। এই বয়সে শিশু নিজেই ঢাকনা ছাড়া কাপ থেকে পানি খাওয়ার মতো কাজ শিখে ফেলে।
আপনার ছোটখাটো নির্দেশনা পালন করতে পারবে
“খেলনাটা নিচে রাখো তো বাবা”, “বিড়ালছানাকে আদর করে দাও লক্ষ্মী” – বয়স ১ বছরের কাছাকাছি হলে শিশু এমন সহজ নির্দেশনাগুলো বুঝে সেগুলো পালন করতে পারবে।
১ বছর বয়সী শিশুর ভাষা ও যোগাযোগের মাইলফলক
শিশুর বয়স যদি ১ বছর হতে বেশি দেরি না থাকে, তাহলে সারাদিন অর্থহীন ধ্বনি বা আওয়াজ শুনতে প্রস্তুত থাকতে পারেন৷ এ বয়সে এসে শিশু ছোট ছোট শব্দ (যেমন: টা টা) উচ্চারণ করার পাশাপাশি বড়দের থেকে শোনা ভঙ্গি নকল করতে শুরু করে।
ইঙ্গিতে কথা বলতে পারবে
এ বয়সে বাচ্চারা মনের ভাব প্রকাশ করতে ইঙ্গিতের ব্যবহার শেখে। হাত নাড়িয়ে বিদায় বলা, মাথা নাড়িয়ে না বলা অথবা হাততালি দেয়ার মাধ্যমে শিশু তার মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখে।
বিভিন্ন রকম গলার স্বর করতে শিখবে
বয়স ১ বছরের কাছাকাছি হলেই খেয়াল করবেন বাচ্চা অনেক ধরনের গলার স্বর করতে পারছে। এসময় নরম স্বর থেকে শুরু করে আবোলতাবোল শব্দ করাও শিখে ফেলে শিশু। বাচ্চার অর্থহীন কথাগুলি লক্ষ্য করলে দেখবেন তার গলার স্বর বড়দের কথার মতো শোনাচ্ছে। সময়ে সময়ে স্বরের ওঠানামাও হচ্ছে।
অল্প কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে
১ বছর পূরণ হলে বাচ্চা প্রথমবারের মতো ‘মা’’ ‘’উহু’ এসব সহজ শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারবে বলে আশা করতে পারেন। এ পর্যায়ে বাচ্চা আপনার কাছ থেকে শুনে বিভিন্ন শব্দ বলার চেষ্টাও করবে।
১ বছর বয়সের সামাজিকতা ও আবেগের মাইলফলক
আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলে বুঝবেন বাচ্চা অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়া শিখতে শুরু করেছে। তবে এ পর্যায়ে ধীরে ধীরে শিশুর আবেগ আরও জটিল হতে শুরু করে। এবং সময়ে সময়ে কান্না, জেদও বেড়ে যায়।
অপরিচিত মানুষ কাছে এলে অস্থির হয়ে পড়বে
এসময় অপরিচিত কেউ কাছে এলে বাচ্চা লজ্জা পায় বা কান্না পেতে শুরু করে। এই বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে এটা খুব স্বাভাবিক। বিষয়টিকে “স্ট্রেইঞ্জার এংজাইটি” বলা হয়ে থাকে। সাধারণত ৯ মাস বয়সে “স্ট্রেইঞ্জার এংজাইটি” শুরু হলেও প্রায় দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর মধ্যে এটি থাকতে পারে।
হাত তালি দিয়ে খেলতে পারবে
এই বয়সে বাচ্চা ছন্দের সাথে মিলিয়ে হাত তালি খেলতে পারে। খেলার মাধ্যমে এভাবেই অন্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে শেখে শিশুরা। এ বয়সে শিশুর সামাজিক মাইলফলকের তালিকায় এটি অন্যতম।
পছন্দের জিনিস ও মানুষ নির্বাচন করবে
আপনার বাচ্চার বয়স ১ বছর পূর্ণ হলেই দেখবেন নির্দিষ্ট কোনো খেলনা তার বেশি প্রিয়। এ বয়সে শিশুরা খেলনার পাশাপাশি প্রিয় মানুষও নির্বাচন করতে শেখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চা তার মা-বাবার কাছেই সবচেয়ে বেশি আরামবোধ করে।
গল্প শোনানোর জন্য বই এগিয়ে দেবে
এই বয়সে বাচ্চার জন্য পড়ার বিষয়টা খুব আনন্দের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করবেন হাতি, ঘোড়া, ফুলের মতো কিছু পরিচিত জিনিসের নাম বললে ঠিক জিনিসের ছবির দিকেই তাকাচ্ছে। এ ছাড়া ঘুমানোর আগে কোন বইটা পড়বেন সেটাও শিশু ঠিক করে দিতে চাইবে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত
প্রত্যেক শিশুই নিজের গতিতে আগায়। তবে আপনার শিশুর মধ্যে এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন।
১২ মাস পূর্ণ হওয়ার পরেও যদি নিচের ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করেন তাহলে ডাক্তার দেখান—
- হামাগুড়ি দিতে না শিখলে বা হামাগুড়ি দেয়ার সময় একপাশে হেলে থাকলে। অনেক বাচ্চাই হামাগুড়ি না দিয়ে সরাসরি উঠে দাঁড়ানো শেখে। সেক্ষেত্রে ভয়ের কিছু নেই।
- কোনোকিছুতে ভর দিয়েও উঠে দাঁড়াতে না পারলে।
- খেলার ছলে কিছু লুকালেও সেটা খোঁজার আগ্রহ না দেখালে।
- সহজ ধ্বনিও উচ্চারণ না করলে।
- হাত নাড়া বা মাথা নাড়ার মতো সহজ ইঙ্গিতগুলো শিখে উঠতে না পারলে।
- ছবি বা অন্যকিছুর দিকে আঙুল তাক করে না দেখালে।
১৮ মাস পূর্ণ হওয়ার পরেও যদি নিচের ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করেন তাহলে ডাক্তার দেখান–
- হাঁটা শুরু না করলে।
- আঙুল তাক করে দেখাতে না পারলে।
- বড়দের নকল করে কথা বলার চেষ্টা না করলে।
- আশেপাশের পরিচিত জিনিস কী কাজে লাগে (যেমন চামচ) তা না বুঝলে।
- অন্তত ৬টি সরল শব্দ (যেমন মা, বাবা, বাই বাই) বলতে না পারলে।
- আগে পূরণ করা কোনো দক্ষতা অল্পদিনের মধ্যে ভুলে গেলে। (যেমন গ্লাসে পানি খাওয়া)
বাচ্চা আরও বড় হওয়ার সাথে সাথে কী হবে ভাবছেন? ১ থেকে ২ বয়সের মধ্যে শিশু খুব দ্রুতই নতুন অনেক কিছু শিখতে শুরু করবে। এসময় আপনার শিশু ভালোভাবে হাঁটা শুরু করবে, আশপাশের জিনিসপত্র মনোযোগ দিয়ে দেখবে, এমনকি আপনার সাথে অর্থপূর্ণ কথা বলাও শুরু করবে।
প্রতিদিন বাচ্চা নতুন কিছু শিখবে। চোখের সামনে আদরের সন্তানের মাইলফলকগুলো অর্জন করতে দেখতে কার না ভালো লাগে?
রেফারেন্স-
- American Academy of Pediatrics, Discontinuing the Bottle
- American Academy of Pediatrics, Emotional and Social Development: 8 to 12 Months
- American Academy of Pediatrics, Developmental Milestones: 12 Months
- Child Mind Institute, Complete Guide to Developmental Milestones
- Centers for Disease Control and Prevention, Milestone Moments
- Centers for Disease Control and Prevention, Important Milestones: Your Child by Eighteen Months
- Centers for Disease Control and Prevention, Toddlers (1-2 Years of Age) Developmental Milestones
- Centers for Disease Control and Prevention, Important Milestones: Your Child by One Year
- National Institutes of Health, National Library of Medicine, Infant—Newborn Development
- Stanford Children’s Health, Age-Appropriate Speech and Language Milestones
- Zero to Three, Stages of Play From 12-24 Months: Young Toddlers Are Problem Solvers