শিশুর খেলা কোন বয়সে কেমন

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

খেলাধুলা শিশুর শারীরিক সক্ষমতা বাড়ায়, বাড়ন্ত মাংসপেশী ও হাড় সবল হতে সাহায্য করে। অ‍্যাকটিভ প্লে বলতে বোঝায় যে খেলায় শিশুর  অংশগ্রহণ থাকে। ধরুন শিশু মোবাইলে ভিডিও গেইমস খেলল, এটা অ‍্যাকটিভ প্লে নয়। 

কিন্তু শিশু মোবাইলে গান শুনে বা দেখে নাচল। এতে যেহেতু ওর হাতে পায়ের নড়াচড়া হচ্ছে–তাই এটা অ‍্যাকটিভ প্লে। এই আর্টিকেলে ‘খেলাধুলা’ বলতে অ‍্যাকটিভ প্লে বোঝানো হয়েছে। কিভাবে শিশুকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করা যায় এখানে সেটি বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

জন্মের অনেক আগে থেকেই শিশুরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করতে শুরু করে। মায়ের পেটে শিশুর নড়াচড়া মা টের পাবার আরো আগে থেকেই শুরু হয়। তাই ঠিক জন্মের পরপরই শিশু নানাধরণের মজাদার ও আনন্দদায়ক খেলাধুলায় মেতে উঠতে পারে।

বিভিন্ন বয়সে খেলাধুলাকে কিভাবে শিশুর প্রতিদিনের রুটিনের অংশ করবেন এবং কেন প্রতিদিন শিশুর খেলাধুলায় অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে আমেরিকার ডাক্তারদের পরামর্শ এখানে আলোচনা করা হল। 

অ‍্যাকটিভ প্লে বলতে কী বোঝায়

খেলাধুলা বলতে প্রথমেই মাথায় আসে দৌড়ঝাঁপ, লাফালাফির কথা। শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়া হয় এমন খেলাকেই  অ‍্যাকটিভ প্লে বলা যায়।

এমনকি সদ‍্য জন্মানো শিশুও মজার মজার খেলায় আনন্দ পায়। উপুত-পাত (টামি টাইম), গড়িয়ে যাওয়া, কোনো একটা খেলনা ধরতে এগিয়ে যাওয়া- শিশুর খেলাধুলা শুরু হতে পারে এসব করে। যখন শিশু নড়াচড়া করতে আরো অভ্যস্ত হতে শুরু করে তখন হাততালি দিয়ে তাকে খেলতে উৎসাহ দিন। শিশুকে বসতে, হামাগুড়ি দিতে, এমনকি প্রথমবারের মতো হাঁটতে উৎসাহিত করাও ধীরে ধীরে শিশুর  খেলাধুলার অংশ হতে শুরু করে। 

শিশুর নড়াচড়া করার ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার পর্যাপ্ত জায়গা আছে এমন যে কোনো জায়গাই  খেলাধুলার জন্য উপযুক্ত। শুধু লক্ষ্য রাখবেন শিশুর খেলার জায়গাটি যেন নিরাপদ হয়। টেবিলের কোণা কিংবা কাঁচের জিনিস– যেগুলোতে শিশুর আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা আছে-এমন কিছু যেন না থাকে।

শিশুকে খেলাধুলায় উৎসাহিত করা কেন গুরুত্বপূর্ণ

ক্লান্ত শিশু ঘুমায় ভালো। খেলাধুলা শিশুকে ক্লান্ত করা ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। শিশুর বাড়ন্ত শরীরের হাড় ও পেশিকে সুস্থ সবল করে তুলতে এবং শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে খেলাধুলা খুব জরুরি।

এছাড়াও খেলাধুলা শিশুকে পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করায়। যার কারণে শিশু আশপাশের জগত সম্পর্কে আগ্রহী ও কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তার চিন্তা ও যোগাযোগ করার দক্ষতা বাড়ে। শিশু তার হাত-পা ব্যবহার করে যখনই নতুন কিছু করতে শেখে, তার আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে বাড়তে থাকে।

ছোটবেলা থেকে খেলাধুলা শিশুর জীবনের পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ‍্যকর অভ্যাসের ভিত্তি গড়ে তোলে। দৌড়াদৌড়ি কিংবা মাঠে ঘাসের ওপর খেলাধুলা, ছোটাছুটি করে  শিশু যে আনন্দ পায় তা পরে প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন কাজে “অ‍্যাকটিভ” থাকার আগ্রহ যোগায়।

কখন থেকে শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা শুরু করবেন

নাভি পড়ার পর থেকেই শিশুকে হাত-পা নাড়াতে উৎসাহিত করুন। শিশুর যখন মাত্র কয়েকদিন বয়স, তখন থেকেই দিনে দু-তিনবার করে শিশুকে ৩-৫  মিনিটের জন‍্য উপুত-পাত (Tummy Time) করান। 


ভিডিও: টামি টাইম কিভাবে করে
https://youtube.com/shorts/VwCty4qAp-M?feature=share

উপুত-পাত করালে শিশুর ঘাড় শক্ত হওয়া, হাতে ভর দিতে পারা এমনকি হামাগুড়ি দেওয়ার জন্য শক্তি পাওয়ার সক্ষমতা বাড়ে। 

কয়েকমাসের মধ্যেই আপনার ছোট্ট শিশুটি নিজে নিজেই আরো চঞ্চল হয়ে উঠবে। তাকে উৎসাহ দিতে থাকুন। শিশু কিছুটা বড় হলে তাকে আপনার তত্ত্বাবধানে সারাদিন নড়াচড়া করার, গড়িয়ে যাওয়ার, কোনো খেলনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার, লাথি মারার অর্থাৎ পা ব্যবহার করার এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে আসা-যাওয়া করার সুযোগ দিন।

যখন শিশু হাঁটতে শুরু করবে তখন শিশুকে নতুন এই ব্যাপারটা আবিস্কার করার এবং নিজে নিজে চলাফেরা করার সময়-সুযোগ দিন। বিশেষজ্ঞরা এ বয়সী শিশুদেরকে দিনে ৩০ মিনিট বড়দের সাথে (adult-led physical activity) খেলতে এবং ৬০ মিনিট তাদের নিজের ইচ্ছেমতোভাবে খেলতে (active free play) সুযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন।

কোন বয়সী শিশুর সাথে কিভাবে খেলবেন

শিশু যত বড় হবে ততই তার দুরন্তপনা, ছোটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ি বাড়বে। এসময় নিশ্চিতভাবে আপনাকেও ওর পিছনে পিছনে দৌড়াতে হবে। 

০- ১২ মাস বয়সী শিশুর খেলা

নবজাতকের খেলা শুরু হয় উপুত-পাতের মাধ্যমে। শুরুর দিকের খেলার সময় অল্প এবং আনন্দদায়ক করার চেষ্টা করুন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আপনি শিশুর রুটিনে আরো মুভমেন্ট হয় এমন অ‍্যাকটিভিটি যুক্ত করতে পারবেন। যেমন শুরুতে শুধু হাত ব্যবহার করে সহজ খেলা দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে শিশুকে বিভিন্ন খেলনার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিন। একসময় তাকে কিছু ধরে দাঁড়াতে দিন।লক্ষণ দেখলে ওকে প্রথমবারের মতো পা ফেলে হাঁটতে সাহায্য করুন।

টামি টাইম বা উপুত-পাত টামি টাইমের সময় শিশুকে খেলনা দিন। এসময়ে তার মুখোমুখি শুয়ে লুকোচুরি খেলুন কিংবা তার সামনে একটি আয়না রাখুন যেখানে সে নিজের প্রতিফলন দেখতে পাবে অথবা তাকে রঙিন খেলনা দিন।

আঙুল খেলা হাত নেড়ে আঙুল নাচিয়ে ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ ধরনের গান কিংবা ছড়া বলা ও শারীরিক অ‍্যাকটিভিটি যা শিশুর মোটর স্কিল (কোনো একটি কাজ করার জন্য পেশির যে দক্ষতা প্রয়োজন) তৈরি করে।  

ফলো মি শিশুকে প্রয়োজনীয় সাপোর্টসহ বসান অথবা তার পেটের ওপর ভর দিয়ে শোয়ান। লক্ষ্য করুন সে কী কী করছে,তাকে অনুকরণ করুন। এতে শিশু এবং আপনি দুজনেই আনন্দে পাবেন।

খেলনাটি ধরো দেখি! শিশু বসতে শিখলে কিংবা হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে, তার সামনে, তার নাগালের একটু বাইরে মজার কোনো খেলনা রাখুন। তাকে খেলনাটি ধরতে উৎসাহিত করুন।

তা তা থৈ থৈ এখনো হাঁটতে শেখেনি এমন শিশুরাও বাদ‍্যযন্ত্রের বাজনা শুনে আনন্দ প্রকাশ করতে পছন্দ করে। শিশুর জন্য এ ধরনের নাচের “পার্টি” আরো আনন্দদায়ক করতে তাকে রঙিন কাপড়, বাবল অথবা ঝুনঝুনি দিন। গান গেয়ে হাত নাড়িয়ে ওকে নাচতে উৎসাহ দিন।


১- ২ বছর বয়সী শিশুর খেলা

ছোট বাচ্চাদের হাঁটা, দৌঁড়ানো, কিছু বেয়ে ওঠা, কিছু ছুঁড়ে মারা–এসব অনুশীলন করতে প্রচুর সময়ের দরকার। শিশুকে উৎসাহ পায় এমন খেলার মাধ্যমে, খেলার মাঠে খেলতে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে, বাসার বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতে দেয়ার মাধ্যমে আপনার ছোট্ট শিশুটিকে এগুলো শেখার অনেক অনেক সুযোগ করে দিন।

ছোট বাচ্চারা এ বয়সে খেলার নিয়মগুলো ধরতে পারে না।আপনি হয়ত ওকে একটি গাড়ি দিয়েছেন। ও সেটা না চালিয়ে উল্টো করে চাকা ঘুরাচ্ছে। তাতে কিন্তু কোনো ক্ষতি নেই! খেলার সঠিক পদ্ধতির ব্যাপারে বেশি সিরিয়াস না হয়ে শিশুকে সহজভাবে তার মতো করে খেলার, কাজ করার সুযোগ করে দিন।

বাধা ডিঙানো ঘরের ভেতরে বা বাইরে শিশুর জন্য বিভিন্ন জায়গায় এমনভাবে কিছু জিনিস রাখুন যেগুলোর ওপরে শিশুর হামাগুড়ি দিয়ে, বেয়ে উঠে কিংবা বাউন্স করে যেতে পারে। যেমন একটা বড় কাবার্ড বাক্সের দুইদিক  খুলে দিন তার ভেতরে যেন সে হামাগুড়ি দিতে পারে। কোনো বড় বালিশ বা কুশন বেয়ে উঠতে তাকে উৎসাহিত করুন অথবা একটা বড় ঝুড়ি/বালতিতে কিছু খেলনা রেখে তাকে ঝুড়িটি টানতে বা ধাক্কা দিতে দিন।

বাইরে হাঁটাহাঁটি শিশুর হাত ধরে বাড়ির আশপাশের জায়গাটা হেঁটে বেড়ান। হাঁটার সময় শিশুকে মজার মজার বিভিন্ন জিনিস দেখান, খেয়াল করুন তার কোনটা বেশি ভালো লাগছে।আশেপাশের জিনিসের নাম ও রং তাকে বলুন। এটা তার কথা বলার দক্ষতাকেও সাহায‍্য করবে। 

জমাও এবং ফেলে দাও শিশুকে একটি বেলচা দিন যা দিয়ে সে ময়লা, খড়-পাতা অথবা বালি তুলে একটি ঝুড়িতে রাখবে এবং পরে ফেলে দেবে। ঘরের ভেতর হলে ব্লকের খেলনার সাহায্যে এটি করা যায়।আমরা কাগজ বা বিভিন্ন পণ‍্যের প‍্যাকেট জমিয়ে সেগুলো এমিলকে ডাস্টবিনে ফেলে আসতে উৎসাহ দেই।

আমাকে ধরো! আস্তে আস্তে দৌঁড়াতে শুরু করুন এবং শিশুকে উৎসাহিত করুন আপনাকে ধরতে। আপনি যত প্রাণবন্তভাবে খেলবেন শিশু ততই খেলতে আগ্রহী হবে।

বাড়ির কাজে ‘সাহায্য’ করতে দিন আপনি বাজার করে ফেরার পর, আপনার শিশুকে বাজারের ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করতে উৎসাহিত করুন। শিশুকে ফ্লোর ‘পরিস্কার’ করার জন্য ছোট ঝাড়ু দিন।

২- ৩ বছর বয়সী শিশুর খেলা

শিশু যখন ভালোভাবে হাঁটতে ও দৌঁড়াতে শেখে তখন তার মধ‍্যে অনুসন্ধানমূলক খেলার সক্ষমতা তৈরি হতে থাকে।

এই সবকিছুই শিশুকে শারীরিকভাবে সক্রিয় থেকে আরো বেশি আনন্দ করার সুযোগ করে দেয়। এমন খেলাধুলা ও কাজে শিশুকে উৎসাহিত করুন যেগুলো শিশুর বাড়ন্ত শরীরের কৌতূহল মেটাতে সাহায্য করবে এবং তার চিন্তাভাবনা ও কল্পনা প্রকাশের পথ করে দেবে।

খেলার মাঠে খেলা শিশুকে স্লাইড, টানেল, দোলনা, বেয়ে ওঠার সেট (ক্লাইম্বিং সেট) ইত্যাদি এর সাথে পরিচিত করার জন্য এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তবে মাঠে খেলার সময় সারাক্ষণ তার ওপর নজর রাখতে ভুলবেন না।

লুকোচুরি খেলা শিশুকে দৌড়ে গিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়তে উৎসাহিত করুন, তারপর গিয়ে তাকে খুঁজে বের করুন। তারপর আপনি লুকিয়ে পড়ে শিশুকে খুঁজে বের করতে দিন। শিশু যদি এই খেলাটি বারবার খেলতে চায় তবে মোটেও অবাক হবেন না।

ফ্রিজ নাচ  গানের আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে নাচতে শুরু করুন। তারপর শিশুকে বলুন গানটা যখন আপনি বন্ধ করে দেবেন, তখন পুরোপু্রি থেমে যেতে।

মুভমেন্ট বই আপনার শিশুর প্রিয় গল্পগুলোয় চরিত্রগুলোকে যেমনভাবে চলাফেরা করতে দেখা যায় দুজনে মিলে সেগুলো অনুকরণ করার চেষ্টা করুন। দেখুনতো, আপনার শিশুটি কুকুরছানার মতো চারপায়ে হাঁটতে কিংবা একটা ঈগল পাখির মতো উড়তে পারে কিনা!

বেলুনটাকে পড়তে দিওনা একটি বেলুন ফুলিয়ে আকাশে ছেড়ে দিন। শিশুকে চেষ্টা করে দেখতে দিন সে কতক্ষণ বেলুনটাকে মাটিতে পড়তে না দিয়ে ওপরে রাখতে পারে।

আপনার শিশুর শারীরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য  খেলাধুলা বা অ‍্যাকটিভ প্লে অত্যন্ত জরুরি। শিশুকে প্রতিদিন নড়াচড়া, চলাফেরা করার সুযোগ করে দিন এবং যেভাবে এবং যতটা সম্ভব তার খেলার আনন্দে অংশ নিন। আপনাকে প্রাণবন্ত দেখলে শিশু চলাফেরা করতে, থাকতে আরো আগ্রহ বোধ করবে যা তার সারাজীবনের সুস্থ অভ্যাসের ভিত্তি গড়ে দেবে।

এ লেখাটি আমেরিকান অ‍্যাকাডেমি অব পিডিয়াট্রিকস (AAP) এর গাইডলাইনের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। তাদের ওয়েবসাইট লিংক:
https://www.aap.org   


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *