শিশুর জ্বর হলে কী করবো

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

শিশুর জ্বর হলে বাবা-মা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন শিশুর জ্বর হয়, জ্বর কত বেশি হলে বা জ্বরের ধরন কেমন হলে সাথে সাথে হাসপাতালে নিতে হবে তা কি আমরা জানি? এসব বিষয় ও জ্বরের সময় শিশুকে বাসায় কিভাবে যত্ন করতে হয় তা আলোচনা করেছেন ডা. ফারিয়া তুজ ফাতিমা।

জ্বর কোনো রোগ নয় বরং এটি অন্য কোনো রোগের লক্ষণ।
জ্বর কোনো রোগ নয় বরং এটি অন্য কোনো রোগের লক্ষণ।

জ্বর শিশুর অস্বস্তির কারণ হলেও, খুব ক্ষতিকর কিছু নয়। সাধারণত জ্বর একটা ইঙ্গিত যে আপনার শিশুর শরীর দেহের ইনফেকশান এর সাথে ঠিকঠাক লড়াই করছে। এবং জ্বর যেহেতু ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বেশি হয় তাই একটা সময় পর নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। 

শিশুর জ্বর হলে আপনি যা করতে পারেন তা হলো, শিশুর একটু আরামের ব্যবস্থা করে দেওয়া, শরীরের তাপমাত্রা মাপা, এবং যে লক্ষণগুলো দেখা গেলে ডাক্তারের কাছে নেওয়া জরুরি সেগুলো আছে কিনা খেয়াল করা।

জ্বর কী

সাধারণত ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রাকে মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হিসেবে ধরা হয়। শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট অথবা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা এর চেয়ে বেশি হলে একে জ্বর হিসেবে ধরা যায়।

জ্বর কোনো রোগ নয় বরং এটি অন্য কোনো রোগের লক্ষণ। শরীরের ভেতর কোনো রোগের সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীর যখন কাজ করে তখনই সেটা জ্বর রূপে প্রকাশ পায় ,জ্বর ওঠা মানেই অসুস্থতা এমনটা ভাবা ঠিক নয়। জ্বর অনেক সময় এটাই প্রমাণ করে যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালোভাবে কাজ করছে 



শিশুর জ্বর উঠেছে, কখন বলব

শিশুর জিহ্বার নিচের তাপমাত্রা যদি ৯৯° ফারেনহাইট এর উপরে থাকে এবং পায়ুপথের অথবা বগলের নিচের তাপমাত্রা যদি ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট অথবা এর ওপরে থাকে তাহলে শিশুর জ্বর আছে বলা যায়।

সাধারণ অবস্থায় শিশুর জ্বর আসার সাথে সাথেই ডাক্তারকে খবর দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। তবুও, করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী সময়ে ডাক্তার হয়তো নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জ্বর এলে শিশুর কোভিড১৯ পরীক্ষা করতে পারেন। মনে রাখবেন, জ্বর সম্পর্কিত এই উপদেশগুলো ভ্যাকসিন নেওয়া শিশুদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। ভ্যাকসিন না নেওয়া শিশুর অনেকদিন ধরে জ্বর থাকলে তার ভাইরাল ফ্লু বা অন‍্য অসুখের আশঙ্কা থাকে। তাই তাদের জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।

কিভাবে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা মাপতে হয়

প্রাথমিকভাবে শিশুর কপালে হাত রেখে শিশুর জ্বর আছে কি নেই তা ধারণা করা যায়। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় হলো থার্মোমিটারে জ্বর মেপে নেওয়া।

শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত জিহ্বার নিচে, বগলে বা পায়ুপথের মুখে থার্মোমিটার রেখে মাপা হয়। 

তিনবছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য পায়ুছিদ্রের মুখে ডিজিটাল থার্মোমিটার রেখে মাপা সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী।  ডিজিটাল থার্মোমিটারের মাথায় ভ্যাসলিন বা পেট্রোলিয়াম জেলি দিয়ে শিশুর পায়ুছিদ্রের মুখে রাখুন ও থার্মোমিটারের সুইচ টিপে দিন, এরপর সংকেত বাজলে বের করুন ও তাপমাত্রা দেখুন।

শিশু যতদিন না ঠোঁট বন্ধ রেখে জিহ্বার নিচে থার্মোমিটারটি ঠিকঠাক ধরে রাখতে সমর্থ হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মুখে থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা ঠিকঠাকভাবে মাপা সম্ভব নয়। সাধারণত শিশুরা তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে এ সক্ষমতা অর্জন করে। তাই তিন বছর অথবা তদুর্ধ্ব শিশুদের ক্ষেত্রে জিহ্বার নিচে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপতে হবে। জিহ্বার নিচে তাপমাত্রা মাপার ক্ষেত্রে এনালগ এবং ডিজিটাল উভয় থার্মোমিটারই ব্যবহার করা যাবে।

বগলের নিচে থার্মোমিটার রেখেও তাপমাত্রা মাপা যায় তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাতে ভুল রিডিং অর্থাৎ তাপমাত্রার পরিমাপ ভুল আসে। যদিও অনেক মা-বাবাই জিহ্বার নিচে কিংবা বগলের তাপমাত্রা মাপাটাই সহজ বলে মনে করেন। জিহ্বার নিচে তাপমাত্রা মাপার ক্ষেত্রে থার্মোমিটার নুন্যতম দেড় থেকে দুই মিনিট ও বগলের নিচে, পায়ুপথের মুখে নুন্যতম তিনমিনিট রাখলেই সঠিক তাপমাত্রা মাপা যাবে।

বাজারে পারদের বা ডিজিটাল দুইধরনের থার্মোমিটারই পাওয়া যায়, যেকোন একটা ব্যবহার করলেই হবে। ব্যবহারের পূর্বে এনালগ বা সাধারণ পারদের থার্মোমিটারটি স্পিরিট বা সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে শুকনো কাপড়ে মুছে নিতে হবে। ডিজিটাল থার্মোমিটার হলে খেয়াল রাখতে হবে, ভেতরে যেন পানি প্রবেশ না করে। সাধারণ থার্মোমিটার হলে পারদের অবস্থান দেখতে হবে। যদি তা ৯৭ ডিগ্রির ওপরে থাকে, তবে জোরে ঝাঁকিয়ে পারদ নিচে নামিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশে ফ্রিদা বেবি রেক্টাল থার্মোমিটার পাবেন ফেসবুক শপ www.facebook.com/paromita.baby
জ্বরের শ্রেণীবিভাগ

সাধারণত ১০০-১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রাকে মৃদু জ্বর।

১০২-১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রাকে মাঝারিমানের জ্বর

এবং তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে তীব্র জ্বর ধরে নেয়া হয়।

মৃদু থেকে মাঝারি মানের জ্বরের চিকিৎসা বাসায় করা সম্ভব।

কেন শিশুর জ্বর হয়

শরীরে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণই জ্বরের প্রধান কারণ। নানা কারণে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে, এই সবগুলো কারণই যে অসুস্থতার সাথে সম্পর্কিত তা নয়। শিশুদের জ্বর হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো হলো:

  • ভাইরাস জনিত যে সকল কারণে জ্বর হয়ে থাকে সেগুলো হল ভাইরাসজনিত ঠান্ডা বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা বা ফ্লু, ডেঙ্গু, চিকেন পক্স, হাম, হ্যান্ড-ফুট- মাউথ সংক্রমণ, করোনা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ ইত্যাদি।
  • ভাইরাস জনিত সংক্রমণে সাধারণত প্রথম ২৪ ঘন্টা জ্বর থাকে এবং পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় অন্যান্য লক্ষণ যেমন কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্ট, পাতলা পায়খানা, শরীরে ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ ইত্যাদি প্রকাশ পায়।
  • ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যেমন ইউরিনারি ট্রাকট ইনফেকশন, মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড –প্যারাটাইফয়েড, এনসেফালাইটিস, ফুসফুস, খাদ্যনালী, লিভা্র,‌ ব্রেন,হার্ট শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানা ধরনের প্রদাহ ও সংক্রমণ, রক্তের নানাধরণের রোগের কারণে জ্বর হয়ে থাকে।
  • ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস জনিত সমস্যা ছাড়াও মশা-মাছি বাহিত বিভিন্ন কারণেও জ্বর হতে পারে, যেমন ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, কালাজ্বর ইত্যাদি।
  • শিশুর ঠান্ডা লাগার কারণে, ফ্লু এর কারণে কিংবা কানের ইনফেকশানের কারণে শিশুর জ্বর আসতে পারে।
  • শিশুদের টিকা দেয়ার পরবর্তী ১২ ঘন্টা থেকে দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত বাচ্চাদের জ্বর থাকতে পারে যা স্বাভাবিক।
  • বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বৃদ্ধি পেতে পারে যা সাধারণত ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর ওপরে ওঠে না বা জ্বরের পর্যায়ে পড়বে না তাই ঘাবড়াবার কিছু নেই।
  • কোভিড-১৯ এর মতো গুরুতর ইনফেকশান, নিউমোনিয়া জ্বরের কারণ হতে পারে।

উল্লেখিত যেকোনো অবস্থায়ই বাবা-মায়ের চিন্তিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জ্বর হওয়া একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত যে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তার শরীর সুস্থ রাখতে ঠিকঠাক কাজ করছে।

আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (এএপি) এর মতে বেশিরভাগ জ্বরই কোনো ক্ষতি করেনা এবং অল্প সময়ে ভালো হয়ে যায়। 

জ্বরের তীব্রতা, জ্বর যে কারণে হয়েছে সেই কারণটার বা সেই সমস্যার তীব্রতার সাথে সবসময় নাও মিলতে পারে। তাই জ্বরের সময় শিশুর যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে কী কারণে শিশুর জ্বর এসেছে তাও খুঁজে বের করতে হবে।

জ্বরের লক্ষণগুলো কী

শিশুর জিহ্বার নিচের তাপমাত্রা ৯৯° ফারেনহাইট এর উপরে অথবা পায়ুপথের অথবা বগলের নিচের তাপমাত্রা ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট অথবা এর ওপরে থাকা জ্বরের প্রধাণ লক্ষণ। এছাড়া জ্বর এলে শিশুর মুখ লালচে হয়ে যেতে পারে, ঘাম হতে পারে,শিশু অনেক তৃষ্ণা অনুভব করতে পারে। শরীরের অন্য কোনো সমস্যার জন্য যদি জ্বর এসে থাকে তাহলে সেই সমস্যার লক্ষণও দেখা দিতে পারে। যেমন, শিশুর যদি বারবার অনেক জ্বর আসে এবং সে যদি কান টানতে থাকে তাহলে এমন হতে পারে যে তার শরীর কানের ইনফেকশানের সাথে যুদ্ধ করছে। 

কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে

এসব লক্ষণ দেখলে শিশুকে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে-

    • তিন মাসের কম বয়সী শিশুর জ্বর ১০০-১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি হলে। ( ৩০ দিনের কম বয়সী শিশুর জ্বর ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে তাকে ইমার্জেন্সি রুমে নিয়ে যেতে হবে)
    • ৩-৬ মাস অথবা তার বেশি বয়সীদের জ্বর যদি ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট অথবা তার চেয়ে বেশি হয়। জ্বরের সাথে কাঁপুনি হলে এবং ৩০ মিনিটের বেশি কাঁপুনি স্থায়ী হলে।
    • শিশু ক্রমাগত কান্না করতে থাকলে  অথবা একেবারেই কান্না না করলে।
    • শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়লে, খেলাধুলায় অনাগ্রহ দেখালে, খেতে না চাইলে।
    • পানিশূন্যতার বিভিন্ন লক্ষণ দেখা গেলে যেমন: কান্না করলে চোখে পানি না আসা, জিহ্বা শুকনো থাকা, চামড়া হালকা টেনে ধরে ছেড়ে দিলে তা আবার আগের জায়গায় ফেরত আসতে সময় বেশি লাগা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া অথবা সারাদিনে একটা শিশুর যতগুলো ডায়পার বদলানো লাগে তার চেয়ে কম ডায়পার খরচ হওয়া। আট ঘন্টার বেশি প্রস্রাব না হলে অথবা গাঢ় রঙের প্রস্রাব গেলে।
    • জ্বরের সাথে ঘাড় শক্ত হয়ে গেলে, হাত-পা অবশ হয়ে গেলে অথবা খিচুনি হলে। প্রচন্ড মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পেটে ব্যথা, চোখের চারপাশে ব্যথা, মেরুদণ্ড বা শরীরের অন্যস্থানে প্রচুর ব্যথা থাকলে।
    • পেট ফাঁপা, পাতলা পায়খানা অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্ষুধামন্দা, অতিরিক্ত বমি এবং ডায়রিয়া হলে।
    • শিশুর শরীরে লালচে অথবা বেগুনি বর্ণের ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ দেখা গেলে।
    • জ্বরের সাথে যদি শ্বাসকষ্ট থাকে অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসে বুকের ভেতরে বাঁশির মতো শব্দ শোনা গেলে।
  • জ্বরের সাথে শিশুর ঠোঁট, জিহ্বা,নখ নীলচে বর্ণ ধারণ করলে।
  • প্রস্রাব এবং পায়খানার কিংবা কফের সাথে রক্ত গেলে, মাড়ি এবং কান থেকে বা শরীরের অন্য জায়গা থেকে রক্তপাত হলে, কান থেকে পুঁজ পড়লে।
  • বাচ্চা যদি আগে থেকেই অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত থাকে যেমন লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার।
  • যদি বাচ্চা কেমোথেরাপি বা স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ নিয়ে থাকে।
  • আপনার যদি কিছু সন্দেহ হয়ে থাকে। এসকল ক্ষেত্রে মা-বাবার ধারণা (intuition) সাধারণত ঠিক হয়ে থাকে।

যেসব লক্ষণ দেখলে শিশুকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে-

  • যদি মনে হয় শিশুর অবস্থার উন্নতি হওয়ার পরিবর্তে অবনতি হচ্ছে।
  • একবার জ্বর চলে যাওয়ার ২৪ ঘন্টা পর আবারও জ্বর আসলে।
  • শিশুর জ্বর নেমে যাওয়ার পরেও যদি শিশু অসুস্থ এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে যেমনঃ খেতে উৎসাহ না দেখায়, বিরক্ত করে, তার যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুম পায়।
  • জ্বর নেমে যাওয়ার পরেও যদি তাকে দুর্বল এবং নিস্তেজ দেখায়।
  • তিনদিনের বেশি সময় ধরে জ্বর থাকলে। মেয়ে শিশুদের প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশান হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে ঠান্ডা লাগার অন্যান্য লক্ষণ না থেকে যদি ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত জ্বর থাকে তবে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ছেলে শিশুদের ও প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশান হতে পারে, তাই তাদের ও বেশিদিন ধরে জ্বর থাকলে ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে।
  • শিশুর কোনো লক্ষণ দেখে যদি আপনার মনে হয় ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন সেক্ষত্রে। যেমন কাশির কারণে যদি শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।

উপরোক্ত যেকোন লক্ষণ দেখা দিলেই দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এছাড়া শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে শিশুর অন্যান্য লক্ষণ, তার সামগ্রিক আচরণ এবং এনার্জি লেভেল নিয়ে আলোচনা করে নিশ্চিত হয়ে নিতে পারেন, এটি ছোটোখাটো কোনো অসুস্থতা নাকি শিশুর চিকিৎসা প্রয়োজন।

কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার

জ্বরের ধরণ, প্রকারভেদ, এবং শারীরিক অন্যান্য লক্ষণ বিচার বিবেচনা করে চিকিৎসক ঠিক করবেন রোগীকে কী পরীক্ষা দিতে হবে।

রক্ত, প্রস্রাব বা পায়খানার পরীক্ষা করা যেতে পারে।

শরীরের যেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সংক্রমণ হয়েছে বলে ডাক্তার সন্দেহ করবেন তার জন্য নির্দিষ্ট বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন আল্ট্রাসনোগ্রাফী, এক্স রে বা সিটিস্ক্যান অবস্থাভেদে আরও নানারকম পরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে পরীক্ষানিরীক্ষা বা ঔষধ ব্যবহার অবশ্যই রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে।

ঘরে জ্বরে আক্রান্ত শিশুর যত্ন

মৃদু ও মাঝারিমানের জ্বরের চিকিৎসা বাড়িতেই করা সম্ভব।

জ্বরের সময় বাড়িতে শিশুর যত্ন নেওয়ার শুরুটা করা যায় শিশুর কিছুটা আরাম হয় এমন ব্যবস্থা করা এবং শিশুর শরীরের পানির চাহিদা পূরণ করার মাধ্যমে। জ্বর এলেই শিশুকে ওষুধ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

তিন মাসের ছোট বয়সের শিশুকে কখনোই জ্বর কমানোর ওষুধ দেওয়া ঠিক নয়। 

শিশুর জ্বরের সাথে সারাগায়ে মাঝারিমানের ব্যথা, হালকা ঘাম, মুখমণ্ডলের লালচে ভাব, ক্ষুধামন্দা, বমি এবং তৃষ্ণা পাওয়া স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে শিশুর জ্বর কমাতে যেভাবে চেষ্টা করতে পারেন:

শিশুর খাবার  (প্রচুর পানীয় খেতে দিন):

জ্বর আক্রান্ত শিশুর প্রচুর ঘাম হয় যার কারণে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়। তাই তাদের শরীরের পানিশূন্যতা দূর করার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি এবং পানি জাতীয় খাবার দিতে হবে।

ছয় মাসের কমবয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বুকের দুধই হল জ্বরের জন্য উত্তম চিকিৎসা। এসময় শিশুকে বারবার বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। অনেকেই ছয়মাসের ছোট বাচ্চাদের জ্বর-কাশি-সর্দিতে গরম পানি, লেবু, মধু ইত্যাদি খাওয়াতে চান, এইসব খাবার ছয়মাসের আগে দিলে উপকারের চেয়ে অপকার হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এসময় শুধুমাত্র বুকের দুধই খাওয়াতে হবে, জ্বরের সাথে যদি উপরে আলোচনা করা হয়েছে এমন লক্ষণগুলো থাকে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খাওয়ানো যেতে পারে।

ছয় মাস অথবা এর চেয়েও বড় শিশুদের পানি, জাউ, সবজি-খিচুড়ি, স্যুপ, মাছ, ডিম, ভিটামিন সি জাতীয় ফলের রস বেশি করে খাওয়াতে হবে, দোকানে যে ইলেক্ট্রোলাইট সলিউশান পাওয়া যায় তাও খাওয়ানো যেতে পারে। 

জ্বর মেটাবলিজম বাড়ায়, যার কারণে শিশুর বেশি পরিমাণ ক্যালরির দরকার হতে পারে। 

জ্বর হলে বাচ্চা খেতে চাইবেনা, বমি করবে, কান্নাকাটি বেশি করবে, এইসময়ে অস্থির না হয়ে ধৈর্য‍্য ধরে বাচ্চাকে বারবার খাওয়ান। কিন্তু, শিশুর ক্ষুধা না থাকলে শিশুকে জোর করে খাওয়াবেন না।

শিশুকে ঠান্ডা রাখুন:

আমরা অনেকেই জ্বর উঠলে শিশুকে আঁটসাট কাপড় এবং কাঁথা কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রাখি,যেটা একেবারেই করা যাবেনা। শিশুর গরম লাগলে তার ঘাম হতে পারে, শরীর লাল হয়ে যেতে পারে এবং সে কান্নাকাটি করতে পারে। এক্ষেত্রে শিশুকে খোলামেলা কাপড় পরানো যেতে পারে। তারপরও যদি শিশুর গরম লাগে, তবে ফ্যান অথবা এসি ছেড়ে দিন যেন সে কিছুটা স্বস্তি পায়।

কুসুম গরম পানি দিয়ে গা মুছিয়ে দেওয়া:

জ্বরের সময় আরো খারাপ লাগবে ভেবে অনেকে বাচ্চাকে গোসল করাতে চান না। এটা একটা ভুল। বরং এ সময় গোসল করালে শিশুর আরাম লাগে। তবে অবশ‍্যই গোসলের নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে। 

হালকা কুসুম-গরম পানিতে (৮৫ থেকে ৯০ ডিগ্রি) কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছিয়ে বা স্পঞ্জিং করিয়ে দিলে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা এক দুই ডিগ্রি কমে আসতে পারে। ঠান্ডা পানি ব্যবহার করবেন না। ঠান্ডা পানি ব্যবহার করলে শিশুর কাঁপুনি হতে পারে এবং জ্বরের অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে। শিশুর বাথটাব এক বা দুই ইঞ্চি পানি দিয়ে পূর্ণ করে পরিস্কার একটি কাপড় বা স্পঞ্জ দিয়ে শিশুর গায়ে পানি ছড়িয়ে দিন। যতক্ষণ শিশু এতে আরাম এবং স্বস্তি পায়, ততক্ষণ স্পঞ্জিং করতে থাকুন। শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কমতে শুরু করা পর্যন্ত স্পঞ্জিং করুন। তাপমাত্রা কমতে শুরু করতে ৩০-৪৫ মিনিট সময় লাগতে পারে। শিশু যদি অস্বস্তি অনুভব করে এবং টাব থেকে বের হয়ে যেতে চায়, তাকে থাকতে জোর করবেন না।

হালকা খেলাধুলা

বাচ্চা যদি খেলাধুলা করতে চায় তবে বারণ করা যাবেনা। খেলতে গিয়ে শিশুর গরম লাগতে পারে তাই হালকা খেলাধুলায় শিশুকে সাহায্য করুন।

প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ দিন

তিন মাসের বেশি বয়সী জ্বরাক্রান্ত শিশুকে এসিটোএমাইনোফেন (Tylenol or Feverall/Ace or Napa) ওষুধটি এবং ছয় মাসের বেশি বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল, এসিটোএমাইনোফেন অথবা ইবুপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা যেতে পারে। ওষুধ কতটুকু দেবেন তা বুঝতে লেবেলে লেখা নির্দেশনা অনুসরণ করুন। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা ছাড়া কখনই ১২ সপ্তাহের ছোট শিশুকে কোনো ওষুধ দেবেন না।

শিশুর জ্বর দেখে বড় কোনো অসুখের আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা আপনাকে অস্থির করে তুলতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, বেশিরভাগ সময়ই জ্বর খুব ক্ষতিকর কিংবা চিন্তার কিছু নয়।

আপনার শিশু যদি জ্বর হওয়ার পরেও খেলাধুলায়, খাওয়াদাওয়ায় আগ্রহী থাকে, সতর্ক থাকে, খুশি থাকে, তার গায়ের রঙ স্বাভাবিক থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তার জ্বর হয়তো গুরুতর কোনো অসুখের কারণে হচ্ছেনা। সেক্ষেত্রে শুধু লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখাই যথেষ্ট হবে। কিন্তু যদি আপনার মনে হয় আবারো ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন; এমনকি নিজের মনের শান্তির জন্য প্রয়োজন মনে হলেও ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে দ্বিধা করবেন না।

Comments (04)

  1. suzon kumar
    November 19, 2023

    উপকৃত হলাম

    Reply
  2. suzon kumar
    November 19, 2023

    আমার ১৮ মাসের বাচ্চাকে খিচুনি জ্বর এর জন্য ১৭টি ইঞ্জেকশন দিয়েছে ডক্টরে। রক্তে নাকি ইইনফেকশন হয়েছে
    ।ঔষধের পাশাপাশি কি করলে শিশুর তাপ মাত্রা সাভাবিক থাকবে??ডাক্তার বলেছে জ্বর নাকি কমা বাড়া করবে

    Reply
    • December 6, 2023

      এ বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া আর কারো কথা শোনা ঠিক হবে না।

      Reply
  3. Rezwana Rokoni Dorothy
    September 5, 2024

    Very effective information.Thank you very much.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *