শিশুর পায়খানার কোন রঙ দেখে কী বুঝবেন এবং কখন শিশুকে ডাক্তার দেখাতে হবে তা প্রতিটি বাবা-মায়ের জানা থাকার দরকার।
শিশুর পায়খানার রঙ, গঠন বা ধরন প্রতিদিন– এমনকি প্রতিবারেই বদলাতে পারে। যা দেখে অনেক অভিজ্ঞ বাবা মায়েরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন।শিশুর পায়খানার রঙ কেমন হওয়া স্বাভাবিক এবং কেমন হলে ডাক্তার দেখানো জরুরি বুঝতে লেখাটি পড়ুন।
খাবারের সাথে পায়খানার সম্পর্ক
খাবার হজমের পর যে বর্জ্য শরীর থেকে বের হয়ে যায় সেটাই পায়খানা বা মল। সুতরাং শিশুর খাবারের ওপরে শিশুর পায়খানার রং ও অবস্থা নির্ভর করে। যেসব শিশু বুকের দুধ খায় তাদের পায়খানা মায়ের খাবারের সাথেও সম্পর্কিত।
মা যদি আয়রন ট্যাবলেট বা আয়রন আছে এমন খাবার (যেমন কাঁচকলা) খায় তাহলে শিশু সবুজ/গাঢ় সবুজ এমনকি কালো রঙের পায়খানাও করতে পারে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
শিশু যখন সলিড খাবার খাওয়া শুরু করে তখনও নানা রঙের পায়খানা করতে পারে। এবং এ সবই তার খাবারের সাথে সম্পর্কিত।
আপনি যদি শিশুর পায়খানা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন তাহলে এ তিনটি লক্ষণ আছে কিনা খেয়াল করুন।
১. শিশু যদি পায়খানার সময় কান্না করে
২. শিশু যদি দুর্বলবোধ করে বা খেলাধুলা করতে না চায়
৩. শিশু যদি সারাদিন শুয়ে থাকে
এসব লক্ষণ দেখলে শিশুকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
শিশু যদি হাসিখুশি ও অ্যাকটিভ থাকে তাহলে পায়খানা যতবারই করুক আর যে রঙেরই হোক চিন্তার কিছু নেই।
সমস্যাটা হয় নবজাতক বা মাত্র জন্ম নেয়া শিশুর ক্ষেত্রে। কারণ তারা সারাদিন এমনিতেও ঘুমিয়ে থাকে। তাই নবজাতকের পায়খানার রং দেখেই বুঝে নিতে হয় শিশু ভালো আছে নাকি কোনো অসুখ হয়েছে।
০-৩ মাস বয়সী শিশুর পায়খানার রঙ দেখে কী বুঝবেন তা নিচে আলোচনা করা হল।
নবজাতক শিশুর পায়খানা
সদ্য জন্ম নেয়া শিশু দিনে এক বা দুইবার পায়খানা করে। শিশুর বয়স এক সপ্তাহ হতে হতে দিনে ৫ থেকে ১০ বার করে পায়খানা করে। শিশু যত বড় হতে থাকবে এবং বেশি খেতে শুরু করবে, তত দৈনিক পায়খানার সংখ্যা কমে আসবে। এইভাবে শিশুর যখন প্রায় ৬ সপ্তাহ বয়স হবে তখন হয়তো সে প্রতি দুই একদিনে একবার করে পায়খানা করবে।
শিশু বুকের দুধ খাচ্ছে নাকি ফরমুলা খাচ্ছে তার ভিত্তিতে নবজাতক শিশুর পায়খানার রঙ এবং ধরণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। বুকের দুধ খায় এমন শিশুর পায়খানা সাধারণত নরম, দানাদার এবং মাঝেমাঝে পাতলা হয়। ফরমুলা খায় এমন শিশুর পায়খানা সাধারণত আরো ঘন এবং ভালো গঠনের হয়।
নবজাতকের কালো পায়খানা
আঠালো, কিছুটা সবুজের মতো (সবুজাভ)-কালো পায়খানা
শিশু জন্মানোর পর প্রথম কয়েকবার হয়তো তার ডায়পার বদলাতে গিয়ে খেয়াল করবেন, আপনার নবজাতকের পায়খানা দেখতে সবুজাভ-কালো এবং আঠালো, কিছুটা আলকাতরার মতো। একে মেকোনিয়াম (Meconium) বলে। মেকোনিয়াম একটা পদার্থ যা শিশু যখন গর্ভে থাকে তখন শিশুর অন্ত্রে/ পেটে থাকে। শিশু জন্মানোর পর প্রথম দিনেই অথবা দু দিনের মধ্যেই এটি পায়খানা হিসেবে বের হয়ে যায়। অর্থাৎ, শিশুর এমন পায়খানা দেখলে বুঝবেন এটি স্বাভাবিক এবং শিশুর শারীরিক প্রক্রিয়া ঠিকঠাক কাজ করছে।
শিশুর ঘন, কালো পায়খানা
শিশুর যখন ৩ দিনের থেকে বেশি বয়স তখন যদি শিশুর ঘন, কালো পায়খানা হয় তবে শিশুর ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। পরিপাকনালীতে রক্তক্ষরণ হলে এমন পায়খানা হতে পারে যা মারাত্মক। (এটি শিশুর প্রথমদিকে করা মেকোনিয়ামযুক্ত পায়খানার চেয়ে আলাদা)
তবে মনে রাখবেন: আয়রন সমৃদ্ধ ফরমুলার (Iron supplements or iron-fortified formula) কারণে কখনো কখনো পায়খানার রঙ এমন কালো বা গাঢ় বাদামী হতে পারে। সেক্ষেত্রে, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
শিশুর সবুজ পায়খানা
শিশুর পাতলা সবুজ পায়খানা
শিশুর যদি দিনে কয়েকবার পানির মতো, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সবুজ, পাতলা পায়খানা হয়, এর মানে হতে পারে শিশুর ডায়রিয়া হয়েছে। বেশিরভাগ সময় শিশুকে নতুন কিছু খাওয়ালে বা শিশু সাধারণত যা খায় তার কোনো পরিবর্তন ঘটালে এমন হতে পারে। মা যদি বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে মায়ের খাওয়াদাওয়ায় পরিবর্তন এলেও এটা হতে পারে। এছাড়া শিশুর যদি এলার্জি থাকে কিংবা Food intolerance থাকে অর্থাৎ, কোনো খাবার যদি শিশুর সহ্য না হয় (যেমন দুধ) তাহলেও শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। বেশি মাত্রায় ডায়রিয়া ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের মতো গুরুতর ব্যাপারের জন্য হতে পারে।
বারবার পাতলা পায়খানা হলে শিশুর শরীরে পানিশুন্যতা অর্থাৎ পানির অভাব তৈরি হতে পারে। যার কারণে শিশু অস্বস্তি অনুভব করতে পারে এবং ডায়পার র্যাশ হতে পারে। এসময় খেয়াল রাখুন শিশু যেন প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার পায়।বেশি সম্ভব না হলেও, যতটা বুকের দুধ কিংবা ফিডারে যতটা খাবার প্রতিদিন খায়, ততটুকু খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।
এছাড়া শিশুকে প্রায় প্রতি ঘন্টায় এক চা চামচ পরিমান ইলেক্ট্রোলাইটস electrolytes (like Pedialyte) দিন। কতটুকু দেবেন তা নিয়ে নিশ্চিত না থাকলে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
২৪ ঘন্টার ও বেশি সময় ধরে পাতলা পায়খানা হলে চিকিৎসার জন্য শিশুর ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। পাতলা পায়খানার সাথে জ্বর এলে, বমি হলে কিংবা শরীরে পানির অভাব দেখা দিলে ডাক্তারের সাথে যত দ্রুত সম্ভব যোগাযোগ করুন।
শিশুর উজ্জ্বল সবুজ পায়খানা
বুকের দুধ খায় এমন নবজাতক শিশুর পায়খানা যদি উজ্জ্বল সবুজ এবং ফেনাযুক্ত হয় তাহলে বুঝতে হবে শিশু এক স্তন থেকে বেশিক্ষণ খাচ্ছেনা, বারবার স্তন পরিবর্তন করে খাচ্ছে। প্রতিবার বুকের দুধ খাওয়ানোর শেষ দিকে যে চর্বিযুক্ত দুধটুকু আসে (Fatty hindmilk) সেটা ও কম পাচ্ছে।
এমন হলে শিশুর পেটে অনেক গ্যাস জমা হতে পারে এবং সে অনেক কান্নাকাটিও করতে পারে। এসময়ে শিশুকে ঘনঘন খাওয়ানোর চেষ্টা করুন এবং খাওয়ানোর সময় নিশ্চিত করুন যে শিশু একটা স্তনের দুধ পুরো খেয়ে শেষ করেছে।
শিশুর হলুদ পায়খানা
শিশুর দানাদার হলুদ পায়খানা
নবজাতকের জন্মের প্রায় তিন চারদিনের মধ্যে, যখন শিশুর শরীর থেকে ‘মেকোনিয়াম’ বের হয়ে যাবে তখন শিশুর যে পায়খানা হয় সেটাকে বলে transitional stool। এই পায়খানা দেখলে বুঝতে হবে শিশুর শরীরে বুকের দুধ অথবা ফরমুলা হজম হতে শুরু করেছে যার কারণে তার শিশুদের মতো সাধারণ পায়খানা হতে শুরু করেছে। এই পায়খানা হালকা রঙের যেমন সবুজাভ-হলুদ কিংবা বাদামী রঙের হয় এবং এর গঠন কিছুটা পাতলা, দানাদার হয়।
বুকের দুধ খায় এমন শিশুর ক্ষেত্রে এই পায়খানা সরিষার মতো (mustard-like) দেখতে হয়। এর রঙ হয় সবুজাভ-হলুদ বা হালকা বাদামী। এই পায়খানা কিছুটা পাতলা, পানির মতো হতে পারে আবার মাঝে মাঝে দানাদার, নরম অথবা ‘curdy’, ক্রিমের মতো, পেস্টের মতো হতে পারে। এর গন্ধ বড়দের পায়খানার মতো নয়, এর কিছুটা মিষ্টি একটা গন্ধ আছে।
শিশুর কিছুটা ঘন হলুদ পায়খানা
ফরমুলা খায় এমন শিশুর ক্ষেত্রে পায়খানার রঙ ফ্যাকাশে হলুদ কিংবা গাঢ় বাদামী হয়। মাঝেমাঝে এতে কিছুটা সবুজ ভাব থাকে। সাধারণত বুকের দুধ খায় এমন শিশুর চেয়ে ফরমুলা খায় এমন শিশুর পায়খানা তুলনামূলক নরম আর ভালো গঠনের হয় (কিছুটা পিনাট বাটারের মতো)
এর গন্ধ সাধারণ পায়খানার মতোই হয়। কিন্তু গন্ধটা সলিড খাবার খায় এমন শিশুর পায়খানার গন্ধের মতো তীব্র নয়।
লিংক: ফরমুলা দুধ কিভাবে ও কেন খাওয়াবো?
শিশুর তরল হলুদ পায়খানা
বেশিরভাগ বাবা-মা হলুদ রঙের তরল/ পাতলা পায়খানাকে শিশুর দাঁত ওঠার লক্ষণ মনে করেন কারণ এ সময়ে শিশু প্রচুর পরিমানে লালা গিলে থাকে। শিশুর হলুদ পাতলা/ পানির মতো পায়খানা একদিনের বেশি সময় ধরে হলে এটা ইনফেকশানের লক্ষণ হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
শিশুর বাদামী পায়খানা
শিশুর ঘন বাদামী পায়খানা
শিশুকে সলিড খাবার দেওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুর পায়খানা নরম এবং হালকা থাকে। শিশুকে সলিড খাবার দেওয়ার পর শিশুর পায়খানার ধরণ রাতারাতি বদলে গিয়ে ঘন, কালচে ধরনের এবং গন্ধপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। এটা দেখতে সুন্দর নাও হতে পারে, কিন্তু এটাই স্বাভাবিক।
শিশুর খাবার যত বড়দের মতো হতে থাকবে তত তার পায়খানার ধরনও বড়দের মতো হতে শুরু করবে।
শিশুর শুকনো, শক্ত বাদামী পায়খানা
শিশুর পায়খানা কালচে ধরনের এবং শক্ত হওয়া কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ হতে পারে।
এক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার জন্য শিশুর ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঘরোয়া পদ্ধতিতে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন না।
শিশুর লাল পায়খানা
শিশুর পায়খানার রঙ এবং আকারে যদি সে শেষ যা খেয়েছে তার ছাপ সরাসরি দেখতে পান যেমন- বীটস বা ড্রাগন ফল খাওয়ার পর যদি উজ্জ্বল লাল রঙের পায়খানা হয়, তবে অবাক হবেন না। শিশুর পাচনতন্ত্র বা খাবার হজমের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরিভাবে গঠিত না থাকার কারণে পাচনতন্ত্র দিয়ে খাবার যাওয়ার সময় খাবারের খুব একটা পরিবর্তন হয়না বলে এমনটা হয়।
কিন্তু শিশুর পায়খানায় গোলাপী বা লাল দাগের কারণ রক্তও হতে পারে। এক্ষেত্রে শুরুতেই বেশি দুশ্চিন্তা না করে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
শিশুর লাল পায়খানা যেসব কারণে হতে পারে:
- যদি জন্মের প্রথম কিছুদিনের মধ্যে শিশুর লাল পায়খানা হয় তবে তা সে ডেলিভারির সময় যদি কিছুটা রক্ত গিলে ফেলে থাকে তার জন্য হতে পারে।
- যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় তবে মায়ের নিপলে কোনো কাটা থাকলে, সেখান থেকে যদি কিছুটা রক্ত শিশুর পেটে গিয়ে থাকে তার কারণে হতে পারে।
- দুধ বা অন্য কোনো খাবারের এলার্জির কারণে হতে পারে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য বা অন্য কোনো কারণে শিশুর পায়খানার রাস্তায় কেটে গেলে/ টিস্যু ছিঁড়ে গেলে তার কারণে হতে পারে।
- ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকজনিত ইনফেকশানের কারণে।
শিশুর কমলা পায়খানা
লাল পায়খানার মতোই, শিশু যদি কমলা বর্ণের কিছু খেয়ে থাকে বিশেষ করে বেটা কেরোটিনযুক্ত (beta carotene) কোনো ফল বা সবজি যেমন আলু, গাজর, কুমড়া বা কমলা খেয়ে থাকে তবে তার কমলা রঙের পায়খানা হতে পারে।
আবার কিছু ওষুধপত্রের কারণেও শিশুর কমলা পায়খানা হতে পারে। কিছু এন্টিবায়োটিক, এন্টাসিডে এলুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড নামের একটা উপাদান থাকে যার প্রভাবে পায়খানার রঙ কমলা হতে পারে।
শিশুর সাদা অথবা ধুসর বর্ণের পায়খানা
এমন পায়খানা সাধারণত বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যায়না। শিশুর চকের মতো, সাদা পায়খানা biliary atresia নামে লিভারের একটি জন্মগত সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। লিভার থেকে গলব্ল্যাডারে যখন পিত্তরস প্রবাহিত হয়না তখন এ অসুখটি হয়। এই অসুখে মৃত্যুঝুঁকি আছে কিন্তু ঠিক সময়ে ধরা পড়লে এটি চিকিৎসা করে ভালো করা সম্ভব। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
প্রচুর আঁশ আছে এমন খাবার, চিয়া সিড, ইসুবগুলের ভুষি ও টক দই হজমে সাহায্য করে। মা প্রতিদিন এসব খাবার খেতে পারেন। ৬ মাস বয়স থেকে শিশুকে প্রতিদিন এক চামচ হলেও টক দই খাওয়ালে শিশুর পায়খানা বা পরিপাকে সুবিধা হয়।
এ লেখাটি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পিডিয়াট্রিকস (AAP) এর গাইডলাইনের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।
আপনার প্রতিটি লেখাই অনেক উপকারী তথ্য বহনকারী। ধন্যবাদ আপু।
আপনার প্রতিটি লেখা অনেক উপকারী ধন্যবাদ আপু
Thanks for your information Apu!
খুবই দরকারী তথ্য পেয়ে চিন্তামুক্ত হলাম। ধন্যবাদ