ছোট্ট শিশুর মিষ্টি হাসি সব মানুষেরই মন গলিয়ে দেয়। নবজাতকের আপন মনে মুচকি হাসি যেন এক অপার্থিব দৃশ্য। অনেক বাবা মায়ের মনেই বাচ্চা হবার পরে এই প্রশ্ন বারবার আসে–আমার শিশু কখন হাসবে?
নতুন মায়ের সব নির্ঘুম রাত, মর্নিং সিকনেস, প্রসবের তীব্র যন্ত্রণা এবং সন্তান লালন-পালনের চাপ সবই যেন সার্থক হয়ে ওঠে শিশুর প্রথম হাসিতে। শিশুর মুখে এক ঝলক হাসি—সে আপনাকে দেখছে, চিনতে পারছে, আপনাকে দেখে আনন্দিত হচ্ছে এর থেকে মিষ্টি অনুভূতি আর কিছু হয় না।
শিশু হাসি থেকে বোঝা যায় যে সে একটু একটু করে সামাজিক দক্ষতা আয়ত্ত করতে শিখছে, সারাদিন খাওয়া-ঘুমের পাশাপাশি সে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শিখছে।
শিশুরা কখন প্রথম হাসে?
শিশুরা মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই হাসতে শুরু করে। অনেকসময় গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার) এর সময়টা বা এর পরে আল্ট্রাসাউন্ডের মধ্যে শিশুর হাসিমুখ কিছুটা বোঝা যায়। পৃথিবীতে আসার পরপরই ঘুমন্ত অবস্থায় প্রথম হাসতে দেখা যায় অনেক শিশুকে।
তবে আপনি হয়তো পরিবারের সদস্য, আশেপাশের লোকজন কিংবা শিশু বিশেষজ্ঞদের কাছে শুনে থাকবেন যে—নবজাতকের হাসি ‘আসল’ হাসি না। বিষয়টি সঠিক। কারণ সদ্যজাত শিশু ঘুমের ঘোরে নিজের মধ্যে হাসার সঙ্গে চারপাশের কিছু দেখে হাসার পার্থক্য আছে। নবজাতক শিশু গ্যাস ছাড়ার সময়, ঘুমিয়ে পড়ার সময়, প্রস্রাব করতে গিয়ে কিংবা আরাম পেলে মৃদু হাসতে পারে। তবে শিশু যে কারণেই হাসুক না কেন আপনি নিঃসংকোচে সেটি উদযাপন করতে পারেন।
আপনি খেয়াল করলে দেখতে পাবেন যে, শিশু মুখ খুলে হাসার আগে কিছুদিন একটু একটু করে মুখ নাড়িয়ে হাসির চেষ্টা করছে, কীভাবে মুখ নাড়াতে হয় সেটা প্র্যাকটিস করছে।
কখন শিশুরা চারপাশের কিছু দেখে হেসে ওঠে?
শিশুর এই ‘আসল’ হাসি সাধারণত প্রায় ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ বয়সে ঘটে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ কাউকে দেখে চিনতে পারলে শিশু হাসতে শুরু করে। যেমন- শিশুর মা ও বাবা। কাউকে দেখে চেনার পর শিশু যখন হাসে তখন সে শুধু তার মুখ নয়, পুরো চেহারাতেই এক ধরনের আনন্দ প্রকাশ করে। আপন মনে হাসির সঙ্গে এই হাসির পার্থক্য আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন।
শিশু খুব দ্রুতই আপনার ও চারপাশের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হাসি ব্যবহার করতে শুরু করবে। ৩ মাসের মধ্যে সে এমনকি ‘আলাপ’ও শুরু করে দিতে পারে। সে আবোলতাবোল শব্দ আর হাসি দিয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে পারে। এসময় আপনি হেসে, আওয়াজ করে বা কথা বলেও তার সঙ্গে ‘আলাপে’র চেষ্টা করতে পারেন।
কীভাবে শিশুকে হাসাতে পারি?
শিশুর সঙ্গে হাসিখুশি থেকে, জড়াজড়ি করে, খেলাধুলা আর বেশি বেশি কথা এক্ষেত্রে খুব কার্যকরী। বেশি আদরে সে বিগড়ে যাবে এমনটা কখনোই ভাববেন না। বরং অনেক গবেষণা বলছে যে, যেসব শিশুরা এই সময়ে বেশি বেশি মা বাবার আহ্লাদ ও যত্ন পায়, তাদের মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক বিকাশ খুব দ্রুত হয়। তাই দ্রুত সেই ‘আসল’ হাসি দেখতে চাইলে তাকে বেশি বেশি আদর করুন, তার সঙ্গে নিজেও হাসিখুশি থাকুন।
শিশুর না হাসার কারণ
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যেমন অনেকেই বেশি হাসিখুশি থাকে, তেমনি শিশুদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। যদি শিশু ১ মাস বয়সেও না হাসে তবে আতঙ্কিত হবেন না। ৪ সপ্তাহ থেকে ৪ মাস বয়সের যেকোনো সময়েই সে হাসতে শুরু করবে।
আপনি হয়তো শুনে থাকবেন যে হাসতে দেরি করা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মিথ্যা না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাসতে দেরি হওয়া ছাড়াও অটিজম স্পেকট্রামের আরও কিছু লক্ষণ থেকে থাকে। যদি আপনার শিশু ৪ মাস বয়সে না হাসে কিন্তু গলার স্বর উঁচু করে, চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করে অর্থাৎ চোখ ও গলার স্বরের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করে, তবে সে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠছে বলে ধারণা করা যায়। এমন হতে পারে যে তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে হাসির ব্যাপারটা কম। অন্তত, তার বিকাশের শুরু দিকে প্রায় নিশ্চিতভাবেই এটা তেমন কোনো উদ্বেগের বিষয় না। তবে অবশ্যই আপনার যেকোনো চিন্তাভাবনা, উদ্বেগ নিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করুন।
কখন শিশু হাসতে এবং উচ্চ শব্দে হাসতে শুরু করে?
মৃদু হাসি শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই শিশু প্রথম শব্দ করে হাসতে শুরু করবে। এটি শিশুর জীবনে সামাজিক বিকাশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। ৩-৪ মাসের দিকে সে হাসতে শুরু করবে বলে আশা করা যায়। তবে এর থেকে কিছুটা দেরি হওয়াও অস্বাভাবিক না। সে প্রায়ই কোনো কারণ ছাড়া এমনি এমনিও হাসতে পারে। শিশুর হাসির এই যাত্রার সবটাই উপভোগ করুন, তার সঙ্গে হাসিখুশি থাকুন।
এ লেখাটি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পিডিয়াট্রিকস (AAP) এর গাইডলাইনের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।
তাদের ওয়েবসাইট লিংক: https://www.aap.org