শিশুর বুদ্ধি বাড়ে যেসব খেলায়

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

শিশুর বুদ্ধি বাড়ে যেসব খেলায় সেগুলো খুবই সহজ ও সাধারণ কৌশল। শিশুর খেলা শুধুই খেলা নয়। খেলার ছলেই শিশুকে শেখানো যায় অনেককিছু। প্রতিদিন শিশুর খেলার পেছনে সময় দিন। কারণ এটা ওর খাওয়ার মতই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর সামাজিক, শারীরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বা ডেভেলপমেন্টের জন‍্য শিশুর খেলার ভূমিকা অনেক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এসব খেলার জন্য আপনাকে অনেক পরিশ্রম বা টাকা খরচ করতে হবে। 

শিশুর খেলা শুধুই খেলা নয়
শিশুর খেলা শুধুই খেলা নয়

এই সিরিজে ঘরের জিনিস দিয়ে প্রতিদিন কিভাবে শিশুর খেলা সম্ভব তা আলোচনা করব। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী কোন বয়সী শিশুর সাথে কিভাবে খেললে শিশুর বুদ্ধি বাড়বে তার কিছু সহজ কৌশল এখান থেকে জানতে পারবেন।

শিশুর বুদ্ধি বাড়ে যেসব খেলায়: ০-৩ মাস বয়স

স্কিন টু স্কিন

মায়ের স্পর্শ সব শিশুরই সবচেয়ে প্রিয়। এটা কিন্তু শুধু সদ‍্য জন্ম নেয়া শিশুর ক্ষেত্রে নয়, সব বয়সের মানুষের জন‍্যই সত‍্য। আবার শিশুর শারীরিক বিকাশের জন‍্য মায়ের স্পর্শ খুবই দরকার। 

স্কিন টু স্কিন যার বাংলা হলো চামড়ার সাথে চামড়া–এটা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায‍্য করে। বাচ্চা জন্মানোর সাথে সাথে মায়ের বুকে শিশুকে দেয়া হয়। প্রতিদিন এ বয়সী শিশুকে মায়ের স্পর্শ, গায়ের উত্তাপ যত বেশি সময় দিবেন, শিশুর মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক বিকাশ তত ভালো হবে।

শিশু বা মা গোসল করার সময় পরস্পরকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখতে পারেন। দুধ খাওয়ানোর সময়, টামি টাইমের সময় শিশুকে মায়ের বুকের উপরে শুইয়ে রাখুন।   

স্কিন টু স্কিন বাবার সাথেও করা যায়
স্কিন টু স্কিন বাবার সাথেও করা যায়

টামি টাইম বা উপুত-পাত

শিশু যদি ফুল-টার্ম বা সুস্থভাবে জন্মায়, নাভি পড়ে যাবার পর থেকেই তাকে টামি টাইম (Tummy Time) দেয়া যায়। ৬-৭ মাসের আগে যে সময়টায় বাচ্চা উপুড় হতে পারে না সে সময়টায় পেটের ওপর ভর দিয়ে উপুড় হয়ে থাকাকে টামি টাইম বলে।

টামি টাইমের অনেক উপকারিতা আছে। তবে সদ‍্যজাত শিশু এটা পছন্দ না করাই স্বাভাবিক। টামি টাইমকে আনন্দময় করার ২টি উপায় হলো–

১. মা বা বাবার বুকের উপরে শুইয়ে টামি টাইম করানো

২. সামনে কোনো আকর্ষণীয় খেলনা দিয়ে (আয়না বা সাদা কালো বই/কাগজ) টামি টাইম করানো

বিদেশে ঘাসের উপরে শিশুকে রেখেও টামি টাইম করানো হয়
বিদেশে ঘাসের উপরে শিশুকে রেখেও টামি টাইম করানো হয়

পা দিয়ে ধাক্কা বা লাথি দেয়া 

মায়ের গর্ভে শিশুর পা ভাঁজ করা অবস্থায় থাকে। জন্মের পর পা মেলতে শুরু করে। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, শিশু তার পায়ের নাগালে যা পায় সবকিছু ধাক্কা দিতে চায়। এই সাধারণ কাজটি তার পা শক্তিশালী করতে এবং পায়ের পেশি বা মাসল গঠনে সাহায্য করে।  তাই শিশুর পায়ের কাছে ছোট বালিশ/কম্বল বা কাঁথা ভাঁজ করে ওকে পা দিয়ে ধাক্কা দিতে দিন। আপনার হাতের তালু ওর পায়ের কাছে ধরে লাথি দিতে উসাহ দিন।  

শব্দ ও দৃষ্টিশক্তি অনুসরণ 

প্রথম মাসে শিশু শুধুই খায় আর ঘুমায়। ১ মাস বয়সের পর থেকে সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে চারপাশে তাকাতে শুরু করে। আশেপাশের সবকিছু দেখতে এবং শব্দের প্রতি আগ্রহী হয়। খুব সহজ কিছু খেলার মাধ্যমে আপনি তার ইন্দ্রিয়গুলোর বিকাশে তথা শিশুর বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করতে পারেন। 

  • ঘৃুরছে এমন খেলনা ওর চোখের সামনে ঝোলানো। বাংলাদেশে সবার বাসায় সিলিং ফ‍্যান থাকে। দেখবেন শিশু সেটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। ফ‍্যানের মত দ্রুত ঘুরছে এমন না হলেও, ধীরে ধীরে ঘোরে এবং নড়ে এমন খেলনা ওকে এসময় সাহায‍্য করবে।   
  • ঝুনঝুনির মত খেলনা দিয়ে তার মাথার চারপাশে শব্দ করা যাতে শব্দ কোথা থেকে আসছে সেটা সে খোঁজে। এদিক ওদিক ফিরে তাকায়। তবে অতিরিক্ত শব্দ/যান্ত্রিক খেলনা নয়, খুব সাধারণ ঝুনঝুনি ব‍্যবহার করাই ভালো। 
  • চোখের উপর সাদা কালো (এসময় এটাই সবচেয়ে ভালো করে দেখে) কাগজ নাড়ানো। 

শিশুর মুখের কাছে গিয়ে হাত-পা নেড়ে গল্প করা। তাকে আদর করা। কারণ এই সময় থেকেই শিশু অন‍্যের চেহারা, কণ্ঠস্বর চিনতে শুরু করে।

আরো পড়ুন: শিশুর সাথে কথা বলব যেভাবে
আরো পড়ুন: শিশুকে কথা বলা শেখাবো যেভাবে
শিশুর বুদ্ধি বাড়ে যেসব খেলায়: ৪-৮ মাস বয়স

পরিবেশ পরিচয়

শিশুকে প্রতিদিন সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবেন। কোথায় কী আছে, সেগুলোর রং কী, আকৃতি কী এবং কাজ কী– গল্পের ছলে বর্ণনা করবেন। এতে করে সে প্রতিদিন ব‍্যবহার করা হয় এমন জিনিস ও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানবে। নিজের পরিবেশ সম্পর্কেও জানবে। এই কাজটি শিশুর বুদ্ধি তথা মানসিক বিকাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এতে তার ভাষাদক্ষতা তৈরি হয়।  

টামি টাইম 

শিশুর হামাগুড়ি এবং হাঁটার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন, সেই শক্তি অর্জনের জন্য টামি টাইম করানোই সবচেয়ে ভালো উপায়। এই বয়সে টামি টাইম করানো বেশ কঠিন। আপনি নানা কৌশলে শিশুর টামি টাইম বাড়াতে পারেন।  

যেমন–

  • একটি ছোট বালিশ, টাওয়াল বা কম্বল শিশুর বুকের নিচে রেখে দিতে পারেন যাতে সে কিছুটা আরাম পায় এবং খুব সহজেই মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতে পারে। বাজারে টামি টাইম পিলো বা বালিশও কিনতে পাওয়া যায়। 
  • শিশুর হাতের নাগালে কোনো প‍্যাকেট (যেটা ধরলে শব্দ হয় যেমন বিস্কুটের প‍্যাকেট), ঝুনঝুনি বা বল জাতীয় উজ্জ্বল রংয়ের খেলনা রেখে দিতে পারেন যেন সে অনেকক্ষণ ওই খেলনা দিয়ে খেলে কাটাতে পারে। 
  • শিশুর মুখের সামনে একটি আয়না (প্লাস্টিকের আয়না নিরাপদ) রেখে দিন যাতে সে উপুড় হওয়া অবস্থায় নিজেকে দেখতে পায়। নিজের নড়াচড়া দেখা এবং নিজের দিকে হাত বাড়ানো ওর টামি টাইমকে উপভোগ‍্য করবে।  

লাথি মারার মাধ্যমে খেলা 

লাথি মারার ফলে শিশুর রোলিং বা গড়াগড়ি করার জন্য প্রয়োজনীয় পেশী তৈরি হয়। লাথি মারা শিশুর জন্য অনেক উত্তেজনাপূর্ণ একটি খেলা কারণ এর প্রতিক্রিয়াটা তাৎক্ষণিক হয়, যেমন কোথাও লাথি মারলে সাথে সাথে শরীরে একটা কম্পন অনুভূতি হয়। তাই তারা এই খেলাটা খুবই উপভোগ করে। শিশুর পায়ের কাছে যদি এমন কিছু রাখেন যেটা শব্দ করে (যেমন বিস্কুটের খালি প‍্যাকেট বা পলিথিন) সে লাথি মেরে খুবই আনন্দ পাবে। এবং এ থেকে সে শিখবে কারণ ও ফলাফল (আমি এটা করলে ওখানে আওয়াজ হয়) যা শিশুর বুদ্ধি বাড়াতেও সহায়ক।  

বালিশের উপর হামাগুড়ি 

বালিশের উপর হামাগুড়ি দেয়ার মাধ‍্যমে শিশুর পেশীকে শক্তিশালী করার সুযোগ দিতে পারেন। আবার এই বালিশ দিয়ে বানানো পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে একই সাথে তার ব্রেইনেরও কম খাটনি হবে না। 

এ বয়সে শিশু নানা কাজে নিজের শক্তি ব‍্যয় করতে চায়। তাই ঘরের ভেতরে বা বাইরে শিশুর জন্য বিভিন্ন জায়গায় এমনভাবে কিছু জিনিস রাখুন যেগুলোর ওপরে সে হামাগুড়ি দিয়ে, বেয়ে উঠে কিংবা বাউন্স করে যেতে পারে। কোন বড় বালিশ বা কুশন দিয়ে তাকে সেখানে উঠতে বা বাইতে উৎসাহিত করুন। এতে ওর সময়ও কাটবে। শিশুর বুদ্ধি বাড়াতেও দারুণ কৌশল এটা। 

মজার ব‍্যাগ

এ ব‍্যাগটা বানাতে একটু সময় লাগবে কিন্তু বাচ্চারা এটা দারুণ পছন্দ করে। একটা পলিথিন নিন (নিতে পারেন চিপসের প‍্যাকেট কারণ এগুলি শব্দ করে) এর ভেতরে পানি, বোতাম, খড়, মটরদানা, বাদাম, ছোলা বা অন্য কিছু দিয়ে এমন ব‍্যাগ বানান যেটি নাড়ালে শব্দ হবে। এরপর তাকে এই ব্যাগগুলো দিয়ে খেলতে দিন। প্লাষ্টিকের বোতলেও এগুলো ভরে খেলতে দিতে পারেন। প্লাস্টিকের বোতলের অর্ধেক পানিতে ভরে উল্টেপাল্টে নাড়িয়ে খেলতে দিন। 

এ খেলাগুলি শিশুর জন‍্য শুধু আনন্দের নয়, শিক্ষারও। মজার ব্যাগের ভেতরের ছোট ছোট জিনিসগুলো তাকে বের করতে দিতেও পারেন তবে এ সময় শিশুকে একদম চোখে চোখে রাখবেন। সে যেন ব্যাগটি বা ভেতরের জিনিস মুখে না দেয়। 

শিশুর বুদ্ধি বাড়ে যেসব খেলায়: ৯-১২ মাস বয়স

বালতি বা ঝুড়ি দিয়ে খেলা 

আমাদের সবার বাসায়ই ময়লা কাপড় জমানোর জন্য একটি ঝুড়ি বা বালতি থাকে। শিশুকে ঝুড়ি থেকে কাপড় বের করার খেলাটি খেলতে দিতে পারেন। যখন সে ঝুড়ি থেকে কাপড়গুলো টেনে বের করতে পারবে তখন নিজেকে বিজয়ী মনে করবে। এই সহজ কাজটি তাদের সমস্যা সমাধান এবং মোটর দক্ষতা অনুশীলনে সাহায্য করে। 

পানি ও বরফ 

একটা পাত্রে পানির মধ্যে কতগুলো বরফ নিয়ে শিশুকে খেলতে দিন। শুধু এই পানি-বরফ খেলার মাধ্যমে সে শিখবে তাপমাত্রা (ঠাণ্ডা-গরম), কোনটা কঠিন পদার্থ এবং কোনটা তরল পদার্থ সেটাও বুঝবে। তাছাড়া এই খেলার সময় যখন তার চোখে মুখে পানির ছিটা আসবে, সে খুবই আনন্দ পাবে। 

শিশুর বিকাশের প্রতিটি স্তরে পানি দিয়ে খেলা দারুণ কাজে আসে। মনে রাখবেন, পানি দিয়ে খেললে কখনোই শিশুর ঠাণ্ডার অসুখ হয় না। তবে পানি যেন পরিস্কার হয়।

শিশুরা পানি দিয়ে খেলতে দারুণ ভালোবাসে
শিশুরা পানি দিয়ে খেলতে দারুণ ভালোবাসে

বোতল এবং বয়াম

বোতল এবং বয়ামের ঢাকনা খোলা ও লাগানো একটা দারুণ খেলা। এটা শিশুর বুদ্ধি বাড়াতে যেমন কার্যকর, তেমন শিশুর জন‍্য বেশ আনন্দের কাজও। ঘরের নানা আকৃতির বয়াম (যেগুলোর ঢাকনা খোলা সহজ) সেগুলো ওকে খুলতে-বাঁধতে দিন। প্রথম দিকে প্রয়োজনে ওকে সাহায‍্য করুন। ১ বছর+ শিশু নিজেই এ কাজ করতে পারে। 

বিস্কুটের টিন

বিস্কুটের টিন থেকে বিস্কুট বের করা ও ঢোকানো, কিংবা বল ঢুকানো ও বের করা– এর মাধ‍‍্যমে শিশু তার হাত ও আঙুলের পেশীর দক্ষতা তৈরি করে।  

গুপ্তধনের ঝুড়ি 

ঝুড়িই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। হতে পারে কাগজের বাক্স কিংবা প্লাস্টিকের/টিনের বালতি। শিশুর পরিবেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের উপাদান (যেমন গাছ, পাতা, ফুল, ইট, পাথর) এবং আপনার বাসার বিভিন্ন জিনিস নিয়ে একটি ঝুড়ি সাজিয়ে শিশুকে দিতে পারেন। ঝুড়ির এই জিনিসগুলো দিয়ে খেলার সময় তার ভেতরে নিজের জগতটাকে আবিষ্কার করার সহজাত কৌতূহল তৈরি হবে। 

আরো পড়ুন: কেন মোবাইল/টিভি শিশুর জন‍্য ক্ষতিকর
আরো পড়ুন: কেন মোবাইল/টিভি শিশুর জন‍্য ক্ষতিকর

শিশুর সাথে গান করুন 

সংগীত ব্রেনের গঠন এবং মন-মেজাজ ভালো রাখার চমৎকার একটি উপাদান। মনে রাখবেন গান মানেই নারী-পুরুষের প্রেমের গান নয়। প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় সঙ্গীত সুর ও কথা সম্বলিত (আযান, কীর্তন, মন্ত্র, দোয়া)। আপনার পছন্দের গান গুনগুন করে গেয়ে শোনান শিশুকে। জোরে গান চালিয়ে শিশুকে নিয়ে নাচুন এবং সময়টা উপভোগ করুন। এমনকি শিশু যখন ঘুমায় তখনও হোয়াইট নয়েজ বা প্রশান্তির সুর (যেমন বৃষ্টির আওয়াজ) চালিয়ে রাখলে শিশুর ঘুম ভালো হয়। মা গান গেয়ে মোবাইলে রেকর্ড করে সেটি বাজিয়ে রাখতে পারেন। 

মায়ের কণ্ঠস্বর যতই পঁচা হোক, শিশুর কাছে সেটাই সবচেয়ে প্রিয়।  

রেফারেন্স:

  1. The National Association of Education for Young Children( NAYEC) https://www.naeyc.org/
  2. American Academy of Pediatrics (AAP):  https://www.aap.org

 

Comment (01)

  1. Riya Ahmed
    April 16, 2024

    Erokom ro onek lekha porte chai janar jonno

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *