বিশ্বে ৫ বছরের কমবয়সী যত শিশু মারা যায় তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। বাংলাদেশেও এ রোগে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা লক্ষণীয়। নিউমোনিয়া একটি মারাত্মক রোগ হলেও পর্যাপ্ত পুষ্টি ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত এবং টিকার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
নিউমোনিয়া কী
নিউমোনিয়া শ্বাসযন্ত্রের এক ধরনের তীব্র সংক্রমণ যা ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ফুসফুস মূলত অ্যালভিওলি থলি দিয়ে গঠিত। যখন আমরা নিঃশ্বাস নেই তখন এই থলিটি বাতাস দিয়ে পূর্ণ হয়। নিউমোনিয়া হলে ফুসফুসের এই অ্যালিভিওলি থলি পুঁজ ও তরলে পূর্ণ হয়ে যায়। তখন নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। ফলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।
সারা বিশ্বে শিশুমৃত্যুর একটি বড় কারণ নিউমোনিয়া। ২০১৯ সালে ৭ লাখ ৪০ হাজার ১৮০ জন ৫ বছরের কম বয়সী শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে।বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ার কারণে।
সব দেশেই শিশুরা কমবেশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। সহজ কয়েকটি উপায়ে শিশুকে নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। তাছাড়া কম খরচে, কম প্রযুক্তির ওষুধ ও সেবায় নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করা যায়।
নিউমোনিয়া কেন হয়?
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকসহ বিভিন্ন সংক্রামক এজেন্ট বা অণুজীবের আক্রমণে নিউমোনিয়া হয়ে থাকে।
- ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার মধ্যে স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া (Streptococcus pneumoniae ) শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়
- হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (Haemophilus influenzae: Hib) ধরনের ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়াও অনেক শিশু আক্রান্ত হয়ে থাকে
- নিউমোনিয়ার সবচেয়ে সাধারণ ভাইরাসটি হলো রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস।
- এইচআইভি সংক্রমিত নবজাতকদের মধ্যে সাধারণত নিউমোসিস্টিজ জিরোভেসি (Pneumocystis jiroveci) সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই ধরনটি এইচআইভি সংক্রমিত শিশুদের মধ্যে অন্তত এক চতুর্থাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ।
নিউমোনিয়া কিভাবে ছড়ায়?
নিউমোনিয়া বিভিন্নভাবে ছড়াতে পারে। সাধারণত নিউমোনিয়ার ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া শিশুর নাক ও গলায় পাওয়া যায়, যা শিশুর নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসকে সংক্রমিত করে।
আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সময় জলীয় কণা বা ড্রপলেট বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে। এ ছাড়া, নিউমোনিয়া রক্তের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে বিশেষ করে জন্মের সময় এবং জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে।
নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী রোগ জীবাণু এবং সংক্রমণের উপায় নিয়ে গবেষণা এখনো শেষ হয়নি, স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা এখনো এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করছেন।
নিউমোনিয়ার লক্ষণ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এসব লক্ষণ দেয়া আছে–
নিউমোনিয়ার সাধারণ উপসর্গ:
- জ্বর (মাঝারি থেকে তীব্র)
- কাশি
- শ্বাসকষ্ট
- শ্বাসকষ্ট বেশি হলে শিশু খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া
শারীরিক উপসর্গ:
- বাচ্চা খুবই বিরক্ত হয়ে থাকবে,
- শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে,
- নাকের ছিদ্র বড়ো বড়ো করে শ্বাস নেবে,
- শরীরে অক্সিজেন খুব বেশি কমে গেলে মাথা ঝাঁকাতে থাকবে,
- তীব্র অবস্থায় ঘড়ঘড় আওয়াজ করতে থাকবে,
- অক্সিজেনের অভাবে শরীর নীল হয়ে যেতে পারে।
বুকের উপসর্গ:
- ঘনঘন শ্বাস নেওয়া
- ০-২ মাস: মিনিটে ৬০ বারের বেশি শ্বাস
- ২-১২ মাস: মিনিটে ৫০ বারের বেশি শ্বাস
- ১-৫ বছর: ৪০ বারের বেশি শ্বাস
- বুক ভিতরের দিকে চেপে যাবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা আছে–
ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটা একই রকম। কিন্তু ভাইরাল নিউমোনিয়ার লক্ষণ কিছুটা মারাত্মক হয়ে থাকে।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর কাশি থাকে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, জ্বর থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে।
সাধারণত নিউমোনিয়া শনাক্ত করা হয় শিশু দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছে কি না কিংবা বুকের নিচের দিকে পাঁজরের দ্রুত উঠানামা করছে কি না সেটি পরীক্ষা করে। শ্বাস নেওয়ার সময় যদি বুকের নিচের দিকের দুপাশ ভেতরের দিকে ঢুকে যায় তাহলে তার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ সুস্থ ব্যক্তি শ্বাস নেওয়ার সময় তার প্রসারিত হয়ে থাকে।
গুরুতর অসুস্থ শিশুরা এ সময়ে খাবার খেতে পারে না বা পানি পান করতে পারে না। অনেক সময় অচেতন হয়ে যায়। হাইপোথার্মিয়া (শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া) এবং খিঁচুনিও হতে পারে।
নিউমোনিয়া কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ?
বেশিরভাগ শিশু শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তবে যেসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে তাদের নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অপুষ্টির কারণে সাধারণত শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়ে থাকে। বিশেষ করে নবজাতক মায়ের বুকের দুধ কম পান করলে পুষ্টিহীনতায় ভোগে।
এ ছাড়া যদি শিশু আগে থেকেই কোনো রোগে আক্রান্ত হয় (যেমন: এইচআইভি বা হাম), সেক্ষেত্রে তার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
পরিবেশ দূষণের কারণেও শিশুর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন-
- বায়োমাস জ্বালানি (যেমন: কাঠ বা গোবর) দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে খাবার রান্না ও গরম করার কারণে ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণ
- ঘনবসতিপূর্ণ বাড়িতে বসবাস
- বাবা ও মায়ের ধূমপান
- দূষিত বায়ুতে শ্বাস প্রশ্বাস
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা
নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এ রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে ভালো মানের অ্যান্টিবায়োটিক হলো অ্যামোক্সিসিলিন (amoxicillin) ডিসপারসিবল ট্যাবলেট।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট দেওয়া হয়, যা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে। অবস্থা গুরুতর হলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
যে কোন ওষুধ খাওয়ানোর আগে অবশ্যই চিকিতসকের পরামর্শ নেবেন। জেনে নেবেন কতদিন, কতটুকু ও কিভাবে ওষুধটি দিতে হবে।
নিউমোনিয়া কিভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব?
হিব, নিউমোকোকাস, হাম এবং হুপিং কাশির (পারটুসিস) টিকা নিউমোনিয়া প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর মূল চাবিকাঠি হলো পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো। জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শিশু শুধু মায়ের বুকের দুধ খেতে পারে তাই তাকে নিয়মিত বুকের দুধ পান করানো উচিত।
বাসার ভেতরে যেসব কারণে বাতাস দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন- কাঠ বা গোবরকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে চুলায় রান্না না করা, বাসায় যদি অনেক লোক বসবাস করে সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিবারে সদস্যরা যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সে বিষয়ে সবাইকে উৎসাহিত করাও নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে পারে।
শিশু যদি এইচআইভি আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি কমাতে প্রতিদিন অ্যান্টিবায়োটিক কোট্রিমক্সাজোল দেওয়া হয়ে থাকে।
×চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করবেন না।
Reference:
Onke valo kothy