ঠাণ্ডার অসুখ বলে প্রচলিত বাংলায় আমরা আসলে ভাইরাসবাহিত রোগ ‘ফ্লু’ কে বোঝাই। ইংরেজিতে এর নাম ‘কমন কোল্ড’। এই ‘কমন’ শব্দের কারণ হলো, এটা বাচ্চাদের (বুড়োদেরও) এত বার হয় যে, একে কমন না বলে উপায় নেই!
সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বাচ্চাদেরও প্রথম ২ বছরে ৮ থেকে ১০ বার এই ভাইরাল ইনফেকশন হতে পারে, যাকে আমরা বলি ‘ঠাণ্ডা লেগেছে’ বা ‘ঠাণ্ডার অসুখ হয়েছে’।
বাচ্চার এত ঘন ঘন ঠান্ডা লাগার মূল কারণ হচ্ছে, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জীবনের প্রথম দিকে বেশ কম থাকে। তাই খুব সহজেই সে যে কোন রোগ সংক্রমণের শিকার হয়। এমনটি ভেবে অপরাধবোধে ভুগবেন না যে, আপনি তাকে যথেষ্ট কাপড় পরাননি বলে, কিংবা সারারাত জানালা খোলা রাখার কারণে বাচ্চার ঠান্ডা লেগেছে। অনেক সময় এক ঠান্ডার অসুখ শেষ হবার আগেই আবারও ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
আপনি যদি নতুন মা/বাবা হন, তবে বাচ্চার বারবার ঠান্ডা লাগার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে আপনাকে উদ্বিগ্ন করে তুলবে। আপনি হয়তো বাচ্চার অসুস্থতা নিয়ে ভীষণ মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগবেন, বিশেষ করে শিশুর বয়স যদি ৩ মাসের কম হয়। এ ক্ষেত্রে আপনি শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে পারেন।
ঠান্ডার অসুখের লক্ষণ
শিশুর ঠান্ডার অসুখের বেশিরভাগ লক্ষণগুলোই বেশ সাধারণ ও হালকা ধরনের হয়। যেমন-
- নাকে সর্দি (প্রথমে নাক দিয়ে পানি পড়া ও আস্তে আস্তে তা হলুদ বা সবুজাভ শ্লেষ্মায় পরিণত হওয়া)
- নাক বন্ধ হয়ে থাকা
- বার বার হাঁচি দেয়া
- হালকা জ্বর হওয়া
- শুকনো কাশি হওয়া (রাতের দিকে বেশি এবং ঠান্ডার অসুখ শেষ হবার আগে অনেক বেড়ে যেতে পারে)
- গলা ব্যথা হওয়া অথবা গলায় খুশখুশ বা চুলকানি অনুভূত হওয়া (শিশুর ক্ষেত্রে খুব সহজে বোঝা যায় না)
- ক্লান্তি বা অবসাদ
- মুখে রুচি না থাকা বা খাবারে অনীহা
ঠান্ডার অসুখের লক্ষণগুলো কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত শিশুদের লক্ষণের সাথেও মিলে যেতে পারে। তাই আপনার বাচ্চার কোভিড-১৯ পরীক্ষাটি করবার প্রয়োজন আছে কিনা, তা জানার জন্য শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে পারেন।
বাচ্চার বারবার ঠান্ডার অসুখ কেন হয়
ঠান্ডার অসুখ সাধারণত শ্বাসযন্ত্রের ওপরের অংশে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে ঘটে। এই ভাইরাস ত্বক থেকে ত্বকের সংস্পর্শে (আক্রান্ত কাউকে স্পর্শ করলে), হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে, অথবা আক্রান্ত কোনো বস্তু স্পর্শ করলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কোনো বাচ্চাকে দেখলে আমরা সাধারণত যা করে থাকি– তাকে স্পর্শ করা, চুমু দেয়া কিংবা জড়িয়ে ধরা– এ কাজগুলো ঠান্ডার অসুখের ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে। প্রায় ২০০ টিরও বেশি ভাইরাস ঠান্ডার অসুখের জন্য দায়ী। আর এ কারণেই বারবার ঠান্ডা লাগার ঘটনা ঘটে থাকে।
শিশুর দেহে যেহেতু এতগুলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠার সুযোগ কম থাকে, তাই ছোট বাচ্চাদের ঠান্ডা লাগার প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়।
তবে এক্ষেত্রে আশার কথা হচ্ছে, বারবার ঠান্ডা লাগলে বাচ্চার সাময়িক কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু এতে বাচ্চার তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। বরং এটা আপনার বাচ্চার দেহের জন্য ভালো কিছু করবে। শরীরে বারবার ভাইরাসের সংক্রমণ আপনার শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, যা ভবিষ্যতে ওর শরীরে জীবাণুর সংক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
বাচ্চার ঠান্ডার অসুখ কতদিন থাকা স্বাভাবিক
ঠান্ডার অসুখ সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে কাশি হয়ে গেলে তা দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে পারে। কাশি ৩ সপ্তাহ পর্যন্তও থাকতে পারে। লক্ষণ অনুযায়ী ঠাণ্ডার অসুখের তৃতীয় দিন সবচেয়ে বেশি খারাপ। বা ওইদিনেই সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে।
ফ্লু ভাইরাস সংক্রমণের সময়কাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে। লক্ষণ প্রকাশের ১/২ দিন আগে থেকেই এই ভাইরাসগুলো সবচেয়ে বেশি সংক্রামক হয়। মানে যার এখনো সর্দি কাশি হয়নি কিন্তু শরীরে ভাইরাস ঢুকেছে তার কাছ থেকেও ভাইরাস অন্যদের মধ্যে সংক্রামিত হবে। আবার সর্দি কাশি যখন শুরু হয়ে যায় তখনও এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে সর্দি যখন শুকিয়ে যায় তখন তা কম সংক্রামক হয়।
ঠান্ডার অসুখের কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা
শিশুকে কোনো ওষুধ দেবার আগে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত। শিশুদেরকে কখনোই বড়দের কাশির ওষুধ দেয়া ঠিক না। কারণ ঠান্ডা বা কাশির বেশিরভাগ ওষুধই শিশুর জন্য নিরাপদ না। শিশুর ঠান্ডার অসুখ কমাতে আপনি এই উপায়গুলো অনুসরণ করতে পারেন-
নাকে জমে থাকা সর্দি বা শ্লেষ্মা পরিষ্কার করা নাক বন্ধ থাকলে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং সে অস্বস্তি বোধ করে থাকে। এমন অবস্থায় আপনি এবং আপনার বাচ্চা –দুজনের কেউই শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন না। তাই সাকশন ব্যবহার করে হালকা হাতে বাচ্চার নাকের সর্দি বের করে ফেলুন। এ ক্ষেত্রে সর্দি বের করার আগে শিশুদের ব্যবহার উপযোগী নাকের ড্রপ প্রয়োগ করে ভেতরের শ্লেষ্মাগুলো নরম করে নিলে সর্দি বের করা বেশ সহজ হয়ে যায়।
- ঘরের আর্দ্রতা বাড়ানো শিশু যে ঘরে থাকে সেখানে যদি হিটার চলে তাহলে অবশ্যই হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন। বাতাস আর্দ্র থাকলে বাচ্চার নাক বন্ধ কম হবে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া তার জন্য সহজ হবে। বাচ্চা যেখানে ঘুমায় তার কাছাকাছি পজিশনে হিউমিডিফায়ার রাখবেন।
- ময়েশ্চারাইজিং লোশন বা পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার ঠান্ডার অসুখ হলে অনেক সময় বাচ্চার নাকের নিচে লাল হয়ে যায়, ছিলে যায়, কিংবা ব্যথা হয়। এ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে বাচ্চার নাকের নিচে ময়শ্চারাইজিং ক্রিম বা পেট্রোলিয়াম জেলি হালকাভাবে লাগিয়ে দিন।
- শিশুর তরল খাবারের পরিমাণ বাড়ানো জ্বর বা ঠান্ডার অসুখের কারণে শিশুর শরীরে পানির পরিমাণ কমে যায়। তাই শিশুকে বার বার তরল খাবার দেয়া জরুরি। মুরগীর ঝোল বা স্যুপ হালকা গরম থাকা অবস্থায় শিশুকে খাওয়ানো যেতে পারে। এ ছাড়াও এ সময় ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবারসহ আরও অনেক পুষ্টিকর খাবার শিশুকে খাওয়ানো প্রয়োজন। তবে আপনার বাচ্চার যদি এখনও সলিড খাবার দেয়ার উপযোগী বয়স না হয়ে থাকে, তাহলে তাকে বুকের দুধ কিংবা ফরমুলা দুধ দিতে হবে।এসময় বাচ্চা যতবার খেতে চায়, ততবার দুধ খাওয়াবেন।
- শিশুর কোন বয়সের জন্য কোন ওষুধটি নিরাপদ –এ সম্পর্কে ধারণা রাখা সব বয়সের শিশুর জন্য সব ওষুধ নিরাপদ নয়। তাই বয়স অনুযায়ী শিশুর জন্য কোন কোন ওষুধ উপযোগী, তা নিশ্চিত হয়ে নিন। যেমন, অ্যাসিটামিনোফেন (টাইলেনল) ২ মাস বা তার বেশি বয়সী শিশুর জন্য নিরাপদ। আবার আইবুপ্রোফেন হলো ৬ মাস বা তার বেশি বয়সী শিশুর জন্য নিরাপদ। আপনার শিশুকে যে কোনো ওষুধ দেয়ার আগে শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে অবশ্যই কথা বলে নেয়া জরুরি।
কী করলে বাচ্চার ঠান্ডার অসুখ হবে না
আসলে ফ্লু’র ভাইরাস থেকে বাচ্চাকে পুরোপুরিভাবে রক্ষা করার কোনো কার্যকর উপায় নেই। তবে ঠান্ডার অসুখ প্রতিরোধের একটি ভালো উপায় হতে পারে হাত ধোয়া। বাচ্চার (বড়দেরও) হাত নিয়মিতভাবে ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, বিশেষ করে বাচ্চার ডায়পার বদলানোর পর এবং খেতে বসার আগে।
যদি আপনার বাচ্চা বেসিন বা সিংকে নিজে নিজে হাত ধুতে পারার মতো যথেষ্ট বড় না হয়,তাহলে আপনি একটি বাটিতে পানি নিয়ে ওর হাত ধুয়ে বা মুছে দিন।
যদি সম্ভব হয়– ঠান্ডা লেগেছে এমন কারো সংস্পর্শ থেকে আপনার শিশুকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন। সর্দির ভাইরাস থাকতে পারে এমন জায়গাগুলো জীবাণুমুক্ত করার জন্য একটি জীবাণুনাশক বা ডিসইনফেক্ট্যান্ট স্প্রে ব্যবহার করুন।
শীতকালে যখন বাতাসে রোগ জীবাণু বেশি থাকে, তখন বাইরে থেকে এসে অবশ্যই জামা কাপড় বদলে হাত ধুয়ে তারপরে বাচ্চাকে ধরবেন। পরিবারের বাইরে যারা বাসায় বেড়াতে আসেন, বাচ্চার কাছে আসার আগে অবশ্যই সাবার দিয়ে হাত ধুতে বলবেন।
ধারণা করা হয়ে থাকে যে, যেসব শিশু বুকের দুধ পান করে তাদের ঠান্ডার অসুখের প্রবণতা কম থাকে।
বাচ্চার ঠান্ডার অসুখ হলে কখন ডাক্তার দেখাবেন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঠান্ডার অসুখ হলে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে ঠান্ডার অসুখের লক্ষণগুলো দেখে যদি আপনার কোভিড-১৯ এর মতো গুরুতর কিছু মনে হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
আপনার বাচ্চার বয়স যদি ৩ মাসের কম হয়, অথবা আপনার বাচ্চার যদি প্রথম বার ঠান্ডার অসুখ হয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই আপনি ভীষণ উদ্বেগ অনুভব করবেন। এমন অবস্থায় আপনার নিজের মনকে শান্ত করার জন্য আপনি শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে পারেন।
এ ছাড়াও আপনার বাচ্চার ঠান্ডার অসুখ যদি গুরুতর রূপ ধারণ করতে থাকে, তবে নিচের লক্ষণগুলো আপনার বাচ্চার মাঝে দেখামাত্র অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
- বাচ্চার যদি প্রথমবার ঠান্ডা লেগে থাকে
- ঠান্ডার অসুখের ফলে যদি বাচ্চার বিশেষ কোনো পরিস্থিতি চোখে পড়ে (রাতে খুব অস্থির থাকা, বা ব্যথার কারণে রাতে জেগে থাকা, যদিও খুব ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা হলেও তা বুঝতে পারা বেশ কঠিন)
- বাচ্চা যদি অবসন্ন থাকে বা দুর্বল হয়ে পড়ে
- বাচ্চা যদি কোনো কিছু খেতে বা পান করতে না চায়
- বাচ্চার বয়স যদি ৩ মাস বা তার বেশি হয় এবং তার যদি ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি জ্বর থাকে (এই বয়সের বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে কোভিড-১৯ টেস্টের প্রয়োজন পড়ে)
- যদি বাচ্চার কাশি দিন দিন বাড়তেই থাকে অথবা অন্য লক্ষণগুলো চলে যাবার পরও দিনের বেলাতেও বাচ্চা কাশতে থাকে
- বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাস যদি স্বাভাবিকের তুলনায় দ্রুত হয়
- যদি বাচ্চার নাক থেকে বা তার কাশির সাথে সবুজাভ হলুদ ও দুর্গন্ধযুক্ত সর্দি বা কফ বের হয়
- যদি বাচ্চার গলার গ্রন্থি ফুলে যায়
- যদি বাচ্চা বারবার কান টানে (এটা দাঁত ওঠারও লক্ষণ)
- যদি লক্ষণগুলো ১০ দিনের বেশি স্থায়ী হয়
যদি আপনার বাচ্চার ঠান্ডার অসুখ সব সময় লেগেই থাকে, অথবা সারাক্ষণই তার নাক দিয়ে পানি পড়ে, অথবা ঠান্ডার অসুখটি যদি বেশ দীর্ঘস্থায়ী বা ঘন ঘন হয়–বিশেষ করে ঠান্ডার অসুখে ভুগতে ভুগতে যদি চোখের নিচে গর্ত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বাচ্চার অ্যালার্জির সমস্যা আছে কিনা তা জানতে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
রেফারেন্স:
- American Academy of Pediatrics, Children and Colds Opens a new window, March 2022.
- American Academy of Pediatrics, Coughs and Colds: Medicines or Home Remedies? Opens a new window, November 2018.
- American Academy of Pediatrics, When to Call the Pediatrician: Fever Opens a new window, November 2015.
- American Academy of Pediatrics, Enterovirus D68: What Parents Need to Know, September 2022.
- American Academy of Pediatrics, Caring for Your Child’s Cold and Flu, February 2022.