এ আর্টিকেলে যা থাকছে
- কখন শিশুকে গরুর দুধ খাওয়ানো শুরু করা যায়?
- কিভাবে শিশুকে গরুর দুধে অভ্যস্ত করা যায়?
- কোন বয়সী বাচ্চার কতটুকু গরুর দুধ খাওয়া উচিত?
- গরুর দুধ বেশি খেলে ক্ষতি কী?
- বাচ্চার জন্য সবচেয়ে ভালো দুধ কোনটি?
- গরুর দুধ পেটে হজম না হলে কী খাওয়াবো?
- বাচ্চা গরুর দুধ খেতে না চাইলে কী করবো?
- দুধের বিকল্প খাবার কোনগুলি?
বাচ্চাকে গরুর দুধ কখন থেকে খাওয়ানো যাবে? বাংলাদেশের ডাক্তাররা ২ বছরের আগে দুধ খাওয়াতে না করে কেন? আমেরিকাতে ১ বছরের বাচ্চাকে, অন্য দেশে আরো আগে কেন গরুর দুধ খাওয়ানো হয়? কোন বয়সে কতটুকু গরুর দুধ দেয়া উচিত? গরুর দুধ থেকে কি কোনো বিপদ হতে পারে? গরুর দুধের পুষ্টিগুণই বা কী! এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই এ আর্টিকেল।
২ বছরের আগে বাচ্চাকে গরুর দুধ দেয়া যাবে না– এটি পুরানো ধারণা। আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এরকম নির্দেশনা দিত। এখন অধিকাংশ উন্নত দেশে গরুর দুধ বাচ্চার ১ বছর বা ১২ মাস থেকে শুরু করা হয়। যেসব শিশু ফরমুলা খায় তাদেরকে ১২ মাস পর থেকে ফরমুলার পরিবর্তে গরুর দুধ খাওয়ানো শুরু করতে পরামর্শ দেয়া হয়। যারা এ সময় বুকের দুধ খাওয়ানো ছেড়ে দেয় তাদেরকেও টিনের দুধ বা কৌটার দুধ শুরু না করে গরুর দুধ শুরু করতে বলে। তবে পরিমাণে খুবই কম! বেশি গরুর দুধ বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে, গরুর দুধ হাই অ্যালার্জিক খাবার, অনেক বাচ্চা দুধ হজমই করতে পারে না। এমন হলে কিন্তু বাচ্চাকে দুধ খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করা যাবে না!
কখন শিশুকে গরুর দুধ খাওয়ানো শুরু করা যায়
বাচ্চার বয়স ১ বছর হলে সাধারণ গরুর দুধ খেতে দিতে পারেন।
১ বছরের চেয়ে ছোট বাচ্চাদের গরুর দুধ খাওয়ানো উচিত না কারণ গরুর দুধে যে পরিমাণ আমিষ থাকে তা হজম করার ক্ষমতা ১ বছরের কম বয়সী শিশুর তৈরি হয়না। এছাড়া জন্মের প্রথম বছরে শিশুর বিকাশের জন্য ভিটামিন ই, জিংক এবং আরো কিছু পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন যেগুলো বুকের দুধ এবং ফরমুলায় থাকে কিন্তু গরুর দুধে থাকে না।
বাজারে ফরমুলা দুধের ঘাটতির সময় শিশুর দুধের চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে দি আমেরিকান একাডেমি অফ পিডিয়াট্রিক্স(এপিপি) ২০২২ সালের মে মাসে পরামর্শ দেয় যে, বাজারের ফরমুলা দুধ পাওয়া না গেলে ৬ মাস বা তার চেয়ে বড় শিশুদের গরুর দুধ খাওয়ানো যেতে পারে কারণ ঘরের বানানো দুধের তুলনায় গরুর দুধ ভালো কাজে দেয়।
তবে, ১ বছরের চেয়ে ছোট বাচ্চাকে নিয়মিত গরুর দুধ খাওয়ার অভ্যাস করানো একেবারেই উচিত না। এ বিষয়ে প্রয়োজনে শিশুর ডাক্তারের সাথে আগে কথা বলে নিন।
কিভাবে শিশুকে গরুর দুধে অভ্যস্ত করা যায়
গরুর দুধের চেয়ে বুকের দুধ আর ফরমুলা বেশি মিষ্টি হয়। তাই কিছু বাচ্চাকে সহজেই গরুর দুধ খাওয়ানো গেলেও কারো কারো এই দুধের অন্যরকম স্বাদের সাথে অভ্যস্ত হতে একটু সময় লাগে।
বাচ্চা যদি গরুর দুধ খেতে পছন্দ না করে তাহলে শুরুতে বুকের দুধ বা ফরমুলার সাথে কিছুটা গরুর দুধ মিশিয়ে খেতে দিন। এতে বাচ্চার জন্য দুধের নতুন স্বাদ এবং ঘনত্বে অভ্যস্ত হওয়া সহজ হবে। এরপর ধীরে ধীরে গরুর দুধের পরিমাণ বাড়াতে থাকুন। এছাড়া বাচ্চার দিনের খাবারের সাথে দুধ মিশিয়ে দিতে পারেন। যেমন সুজি বা সিরিয়াল যাই খাওয়ার অভ্যাস থাকুক না কেন, খাবারে গরুর দুধ ব্যবহার করুন।
কোন বয়সী বাচ্চার কতটুকু গরুর দুধ খাওয়া উচিত
টডলার, অর্থাৎ ১-৩ বছরের বাচ্চাকে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ কাপ (১৬ থেকে ২৪ আউন্স/ ৫০০ থেকে ৬৮০ গ্রাম) গরুর দুধ খাওয়ানো উচিত।
শিশুর বিকাশের জন্য নিয়মিত ফ্যাট (স্নেহ) ছাড়াও আমিষ, জিংক, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি প্রয়োজন। গরুর দুধে এই সব উপাদানই পাওয়া যায়।
বাচ্চার যদি দুধে এলার্জি থাকে বা অন্য কোনো কারনে গরুর দুধ খেতে না পারে, তাহলে তাকে দুধের বিকল্প হিসেবে সয় মিল্ক( সয় দুধ), আমন্ড মিল্ক( কাঠবাদামের দুধ) বা দুধজাতীয় খাবার যেমন দই, পনির খাওয়াতে পারেন।
বাচ্চাকে শুধুমাত্র খাবার বা নাশতা খাওয়ার সময় কাপ থেকে দুধ খেতে দেওয়াই ভালো। কারণ সিপি কাপ (ঢাকনাযুক্ত কাপ) থেকে সারাদিন দুধ খেতে থাকলে বাচ্চার দাঁতে মিষ্টি লেগে থাকতে থাকতে দাঁতে পোকা হয়ে যেতে পারে।
হোল মিল্ক এবং ফ্লেভার ছাড়া দুধই বাচ্চার জন্য সবচেয়ে ভালো।
বাজারে ফ্যাটমুক্ত দুধও পাওয়া যায়,কিন্তু সাধারণ গরুর দুধই ভালো কারণ এতে ফ্যাট থাকে যা শিশুর বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে। তবে ডাক্তার বারণ করলে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
মনে রাখবেন, দুধের তৈরি টকদই ৬ মাস থেকে এবং পনির, চিজসহ অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার ৮ মাস থেকেই বাচ্চাকে দেয়া যায়। বাচ্চা যদি দিনে দুগ্ধজাত খাবার অনেক বেশি খায়, তাহলে তাকে তরল দুধ বেশি খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই!
বাচ্চাদের কেন বেশি গরুর দুধ খেতে দেওয়া যাবে না
অতিরিক্ত হয়ে গেলে ভালো জিনিসও আর ভালো থাকেনা। ঠিকঠাক বেড়ে ওঠার জন্য শিশুর বিভিন্ন ধরণের খাবার প্রয়োজন। বাচ্চা বেশি দুধ খেয়ে ফেললে আর ক্ষুধা না থাকার কারণে সলিড খাবার খেতে চাইবে না। গরুর দুধে আয়রন থাকে না ফলে বাচ্চা যদি আয়রন জাতীয় সলিড খাবার না খায় তাহলে শরীরে আয়রনের অভাব দেখা দিতে পারে।
শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে শিশুর এনিমিয়া( রক্তস্বল্পতা) হতে পারে যার ফলে শরীরে যথেষ্ট লাল রক্তকণিকা উৎপন্ন হয়না। ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া, আচরণগত সমস্যা আয়রনের ঘাটতিজনিত এনিমিয়ার লক্ষণ। তবে সবসময় এই লক্ষণগুলো শুরুতে বোঝা যায় না।
বাচ্চার জন্য সবচেয়ে ভালো দুধ কোনটা
বিদেশের বাজারে হাজারো ধরনের কাউমিল্ক পাওয়া যায়। কিছু দুধ ফ্যাট ছাড়া, কিছু দুধ লো ফ্যাট।এগুলি বাচ্চার জন্য নয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য স্বাভাবিক গরুর দুধ (যেটাতে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে) বেশি উপকারি। যেসব দুধের প্যাকেটের গায়ে ‘হোল মিল্ক’ লেখা থাকে, সেগুলো দেখে কিনুন। এক্ষেত্রে আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করবেন, দুধে যেন কোনো ফ্লেভার না থাকে। হোল মিল্ক লেখা থাকলেও একশ ধরনের ফ্লেভারযুক্ত দুধ বাজারে পাওয়া যায়। এগুলি একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয়।
শিশুর ওজন বেশি হলে অথবা পরিবারের বড়দের হার্টের রোগ, অত্যাধিক ওজন আর উচ্চ রক্তচাপ থাকলে বাচ্চাকে কমানো ফ্যাট (লো ফ্যাট, ১% ফ্যাট) দুধ দেয়ার ব্যাপারে শিশুর ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
দুই বছর বয়স হয়ে গেলে বাচ্চাকে কমানো ফ্যাট এর দুধ খাওয়াতে পারেন।
হোল মিল্ক : সাধারণ গরুর দুধে প্রায় ৪ শতাংশ ফ্যাট বা চর্বি থাকে। বাচ্চাদের ঠিকঠাক শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য একটু বেশি চর্বিযুক্ত খাবারের প্রয়োজন। এছাড়া গরুর দুধে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি আর ভিটামিন বি-১২ থাকে যা শিশুর শারীরিক গঠনে কার্যকরী।
ফ্যাট কমানো দুধ : কম চর্বিযুক্ত দুধ কয়েক রকমের হয় যেমন ফ্যাট কমানো (২ শতাংশ) লো-ফ্যাট (১ শতাংশ) আর ফ্যাট ছাড়া দুধ। এই দুধে সাধারণ গরুর দুধের তুলনায় চর্বির পরিমাণ কম থাকে। বাচ্চার বয়স ২ বছর হলে সাধারণ গরুর দুধের পরিবর্তে দিনে ২ থেকে ২.৫ (আড়াই) কাপ লো-ফ্যাট অথবা ফ্যাট ছাড়া দুধ খাওয়ানোর অভ্যাস করা যেতে পারে।
গরুর দুধ পেটে সহ্য না হলে বাচ্চাকে বিকল্প কী খাওয়াবো
বাচ্চার যদি দুধে এলার্জি থাকে বা দুধ হজমে সমস্যা থাকে তাকে দুধের বিকল্প কিছু খাওয়াতে হতে পারে। দুধের যেসব বিকল্প আছে তাদের সব আবার সমান না।
নন- ডেইরি দুধ হলো দুধের মতো দেখতে এক প্রকার তরল খাদ্য উপাদান যা গবাদি পশু থেকে সংগ্রহ করার দুধের চেয়ে একটু আলাদা। এগুলো চাল, কাঠবাদাম, নারিকেল, ওটস (জই) বা এ জাতীয় শস্য দিয়ে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বা একেক উপাদান তৈরি নন-ডেইরি দুধে পুষ্টি উপাদান ভিন্ন পরিমাণ থাকে। এরকম কিছু দুধের স্বাদ মিষ্টি করার জন্য চিনি দেয়া হয় যা শিশুর জন্য উপকারি নাও হতে পারে। এ কারণেই, পুষ্টিবিদেরা সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিকল্প দুধ খাওয়াতে বারণ করে থাকেন।
তবে সয়াবিন দিয়ে তৈরি করা ফর্টিফাইড সয়মিল্কে ( সয়মিল্কে আলাদা করে পুষ্টি উপাদান যোগ করা হয়) গরুর দুধের সমান পুষ্টি উপাদান থাকে। তাই এই দুধ গরুর দুধের পরিবর্তে খাওয়ানো যেতে পারে। বাচ্চার যদি দুধে এলার্জি বা দুধ হজম করতে সমস্যা হয়, অথবা আপনার পরিবারে প্রাণী থেকে তৈরি করা খাবার খাওয়ার নিয়ম না থাকে তাহলে আপনার শিশুকে সয়মিল্ক খাওয়াতে পারেন।
বাচ্চা গরুর দুধ একদমই খেতে না চাইলে যা করবেন
গরুর দুধ খেতে অনীহা দেখালে বাচ্চাকে এটি খাওয়ার অভ্যাস করাতে আপনাকে একটু বুদ্ধি খরচ করতে হবে। নিচের উপায়গুলো কাজে লাগতে পারে –
বুকের দুধ বা ফরমুলা দুধের সাথে গরুর দুধ মিশিয়ে দিন। অল্প অল্প করে গরুর দুধের পরিমাণ বাড়াতে থাকুন, এক সময় দেখা যাবে বাচ্চা গরুর দুধ খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
দুধের তাপমাত্রা বাড়িয়ে কমিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। বাচ্চা দুধ খাওয়াতে গেলে জেদ করছে কারণ তার হয়তো ঠান্ডা দুধ খেতে ইচ্ছা করেনা। তাই কুসুম গরম দুধ দিয়ে দেখুন।
এটা কিন্তু খুব কাজের!
দুধের সাথে ফল বা বাদাম গুঁড়ো মিশিয়ে দিন। বাচ্চা খেতে পছন্দ করে এমন কোনো ফল দুধের সাথে ব্লেন্ড করে দিলে বাচ্চা গরুর দুধ খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সাধারণ গরুর দুধ বাচ্চাদের খেতে একটু স্বাদহীন লাগে। ফল মেশালে দুধের স্বাদ, রং, ঘনত্ব যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি দুধে ভিটামিন আর আঁশজাতীয় খাদ্য উপাদানও যোগ হয়। তাই আপনার বাচ্চা যদি দুধ খেতে দিলে মুখ সরিয়ে নেয়, দুধের সাথে পছন্দের কোনো ফল ব্লেন্ড করে নিয়ে বলুন “মামনির জন্য মজার দুধ এনেছি!”। আপনার ছোট্ট বাচ্চাটা মজা পেয়ে গরুর দুধ খাবে।
আমি অল্প বাদাম গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়ে অনেক উপকার পেয়েছি।
বাচ্চা দুধ না খেলে যেসব খাবার দেয়া যেতে পারে
বাচ্চা যদি গরুর দুধ একদমই খেতে না চায় তাহলেও অস্থির হওয়ার কিছু নেই। অন্যান্য খাবার নিয়মিত খেলে যথেষ্ট পরিমাণে ভালো চর্বি শরীরে পৌঁছাবে। আপনার শুধু খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চা যেন যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ডি আর ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খায়। এক্ষেত্রে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেয়াই সবচেয়ে বুদ্ধির কাজ হবে।
এছাড়া দুধ খেতে না চাইলে বাচ্চাকে নিচের খাবারগুলো খাওয়ানো যেতে পারে। এগুলোতে প্রচুর ক্যালসিয়াম আছে।
- টকদই
- পনির অথবা চিজ
- টফু
- চিয়া সিড/ তিল (যে দেশে যেটা পাওয়া যায়)
- কেইল শাক, বক চোই এবং পালং শাক (যে দেশে যেটা পাওয়া যায়)
- ব্রকোলি
- মসুর ডাল
- মটরশুঁটি
- কাজুবাদাম
রেফারেন্স:
- American Academy of Pediatrics, Cow’s Milk Alternatives: Parent FAQs
- American Academy of Pediatrics, Recommended Drinks for Young Children Ages 0-5
- Healthy Drinks, Healthy Kids, Healthy Beverage Consumption in Early Childhood
- National Institutes of Health, Office of Dietary Supplements, Calcium