এ আর্টিকেলে যা থাকছে
লাল মাংস বা রেড মিট বলা হয় গরু, ছাগল, শূকর, মহিষ, ভেড়া এসব প্রাণীর মাংসকে। লাল মাংস প্রাণীজ আয়রনের দারুণ উৎস। বাচ্চাকে গরু বা ছাগলের মাংস খাওয়ানো শুরু করার আগে যেসব তথ্য জানা প্রয়োজন তা নিয়েই এই লেখাটি।
বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধিতে লাল মাংসের উপকারিতা রয়েছে। আবার লাল মাংস থেকে মারাত্মক অ্যালার্জিও হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের লাল মাংসের (রেড মিট) চাহিদা গরুর মাংস দিয়ে পূরণ হয়।তাই এখানে বাচ্চাকে গরুর মাংস কখন কিভাবে দিতে হয় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
বাচ্চাকে গরুর মাংস কখন থেকে দেয়া যায়
বাচ্চা যখন সলিড খাবার উপযুক্ত হয় তখন থেকেই তাকে মুরগির মতই গরুর মাংস বা লাল মাংস দিতে পারেন।মুরগির মাংসের মতই, ৬ মাস বয়সে বাচ্চাকে গরুর মাংস দিতে হলে কিমা বা গ্রাউন্ড বিফ আকারে দিতে হবে। এবং পরিমাণও হতে হবে অল্প।বাচ্চা সলিড খাবার খাওয়া শুরুর পরে প্রাথমিক দিকেই বাচ্চাকে গরুর মাংস খেতে দিলে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা অনেকটাই মেটানো সম্ভব।
তবে আমার বাচ্চার মত ২ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো ধরনের মাংস না খেতে চাইলেও চিন্তার কিছু নেই। মাংসের বিকল্প খাবার দিয়ে বাচ্চার শরীরে প্রোটিন ও আয়রনের চাহিদা পূরণ হচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল রাখলেই হল।
বাচ্চাকে গরুর মাংস দেয়া কতটা স্বাস্থ্যকর
গরুর মাংস দ্রুত বাড়তে থাকা বাচ্চার শারীরিক পুষ্টি উপাদানের যোগান দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে প্রচুর পরিমাণে আমিষ আর চর্বি থাকে যা মাংসপেশী গঠন এবং মস্তিষ্কের বৃদ্ধিসহ বাচ্চার বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে। জিংক শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় আর শরীরের কোষের বৃদ্ধি ঘটায়৷ এছাড়া গরুর মাংসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আয়রন। আয়রন বা লৌহ শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটতে সাহায্য করে আর রক্তস্বল্পতার আশঙ্কা কমায়। বাচ্চার বয়স ছয় মাস হয়ে গেলে জন্মের পর থেকে শরীরে জমা আয়রন ফুরাতে থাকে বলে এই সময়ে আয়রনের চাহিদা পূরণ করতে গরুর মাংস দারুণ উপকারী। এছাড়াও ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি১২ আর সেলেনিয়াম অন্যান্য সব পুষ্টিউপাদানের সাথে মিলে শিশুর বেড়ে ওঠা, রক্তের যোগান দেয়া, খেলাধুলা করার শক্তি, খাওয়ার রুচি, হজম শক্তিসহ বিভিন্নভাবে শরীরের সাহায্য করে বলে বাচ্চাকে গরুর মাংস খেতে দেয়া ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে।
বাচ্চা কি গরুর মাংস হজম করতে পারবে
বাচ্চার সলিড খাবার খাওয়ার বয়স হলেই গরুর মাংস হজম করতে পারবে। সাধারণত এ সময়েই (৬ মাস) শিশুর পরিপাকতন্ত্র লাল মাংসের মতো আমিষজাতীয় খাবার হজম করার ক্ষমতা অর্জন করে। তাই ভালোভাবে রান্না করে দেয়া গরুর মাংস শিশুর চিবিয়ে হজম করতে খুব একটা সমস্যা হয়না। বয়সভেদে শিশুকে গরুর মাংস খেতে দেয়ার নিয়ম মেনে চললে হজমে শিশু সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে।
বাচ্চাকে গরুর মাংস দিলে কি অ্যালার্জি হতে পারে
গরুর মাংস থেকে সবার অ্যালার্জি হয় না৷ বাদাম, দুধ, বেগুন থেকে যেরকম অ্যালার্জি হতে পারে, সে তুলনায় গরুর মাংস খেয়ে অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চা বা প্রাপ্তবয়স্ক যে কারোরই গরুর মাংসে অ্যালার্জি দেখা যেতে পারে।
গরুর মাংসের অ্যালার্জি সাধারণত সেরাম অ্যালবুমিন নামে এক ধরণের প্রোটিন আর আলফা-গ্যাল (Alpha gal) নামে এক প্রকারের শর্করা থেকে হয়। কিছু মানুষের যেকোনো যে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংসেই অ্যালার্জি থাকে। যাদের গরুর মাংসে অ্যালার্জি থাকে, মাঝেমাঝে দেখা যায় গরুর দুধ বা দুধ থেকে তৈরি খাবারেও অ্যালার্জি হয়। গরুর মাংস বা অন্যান্য রেড মিটে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সাধারণত খাওয়ার ৩ থেকে ৮ ঘন্টা পরে দেখা যায়।
বাচ্চাকে গরুর মাংস খাওয়ানোর ক্ষেত্রে প্রথমদিকে অল্প খেতে দিয়ে খেয়াল করে দেখুন অ্যালার্জির কোনো লক্ষণ দেখা যায় কিনা। যদি বাচ্চা স্বাভাবিক থাকে তাহলে পরবর্তীতে অল্প অল্প করে আরো বেশি পরিমাণে মাংস খেতে দিন।
বাচ্চাকে কোন ধরনের গরুর মাংস খাওয়াতে হবে
গরুর মাংস বাজারে বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়। এছাড়া সরাসরি কসাইয়ের দোকান থেকে মাংস কিনে এনে সুবিধামত বাচ্চাকে তৈরি করে খাওয়ানো যায়। সাধারণত তিন ধরনের গরুর মাংস বেশি জনপ্রিয়
- টুকরো গরুর মাংস বা স্টেক মিট
- গরুর মাংসের কিমা বা গ্রাউন্ড বিফ
- প্ল্যান্ট-বেইসড মিট বা শাকসব্জি থেকে প্রস্তুতকৃত মাংস
গরুর মাংসের কিমা বা গ্রাউন্ড বিফ
১ বছরের কম বয়সী বাচ্চার জন্য কিমা বা গ্রাউন্ড করা মাংস সবচেয়ে ভালো। কারণ এক্ষেত্রে মাংসের পুষ্টি অক্ষুণ্ণ থাকে, গলায় আটকানোর ভয় কম থাকে।
তবে, গরুর মাংসের কিমা খাওয়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরী। ঠিকমতো সেদ্ধ না হলে এই মাংসে ভয়ংকর ই-কোলাই ভাইরাস আর স্যালমোনেলা ভাইরাস থেকে যেতে পারে। ই-কোলাই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে তীব্র ডায়রিয়া হয়ে শিশুর শারীরিক ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। তবে মাংসের ভেতরের তাপমাত্রা অন্তত ১৬০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ৭১ ডিগ্রী সেলসিয়াস হওয়া পর্যন্ত রান্না করা হলে সেই মাংসে এ ধরনের রোগজীবাণু থাকার সম্ভাবনা থাকে না।
সাধারণত ছোট মিটবল (মাংসের বল) অথবা মাংসের কিমা দিয়ে বার্গার বানিয়ে এই মাংস খাওয়া হয়। বাচ্চার বয়স অনুযায়ী চাবানোর ক্ষমতা ভিন্ন হয় তাই বাচ্চা যেভাবে খেতে পারবে সেভাবেই তাকে তৈরি করে দিতে হবে।
টিপস: গ্রাউন্ডেড চিকেন/বিফ বা যে কোন মাংস পেঁয়াজ রসুন দিয়ে ভালো করে ভেজে সেদ্ধ আলু ও অল্প টমেটোর সাথে মিশিয়ে বল বানিয়ে বাচ্চাকে খেতে দিলে বেশ মজা করে খায়। আমি এ মিশ্রণটা বল বানিয়ে ডিম দিয়ে ভেজে চপের মত করে খেতে দেই। এটাই এমিলের প্রথম এক বছর মাছ/মাংস খাবার একমাত্র রেসিপি।
টুকরো গরুর মাংস বা স্টেক মিট
গরুর মাংসের আস্ত টুকরা রান্না করেই আমাদের দেশের মানুষ বেশি খায়। তবে বর্তমানে গরুর মাংসের স্টেকও বেশ জনপ্রিয় খাবার হয়ে উঠেছে। বাচ্চার খাদ্যাভ্যাসে গরুর মাংস যোগ করার ক্ষেত্রে সাধারণ গরুর টুকরাই সবচেয়ে সহজ সমাধান হতে পারে। টুকরো গরুর মাংসের সাথে সবজি বা শস্যজাতীয় খাবার মিশিয়ে দিলে বাচ্চার জন্য বেশ পুষ্টিকর একটা খাবার হয়ে যায়। তবে শিশুর বয়সের কথা মাথায় রেখে এই ধরনের মাংস রান্নার ক্ষেত্রে তেল ও মসলার পরিমাণ একটু সামলে রাখতে হবে।
প্ল্যান্ট-বেইসড মিট বা উদ্ভিদ থেকে প্রস্তুতকৃত মাংসের বিকল্প
বাচ্চার শরীরের আমিষের চাহিদা মেটাতে বাবা-মায়েরা বর্তমানে বিভিন্ন রকম খাবার খাওয়াচ্ছেন যার মধ্যে প্ল্যান্ট-বেইজড মিট বা উদ্ভিদজাত খাবার থেকে তৈরি মাংসের বিকল্প খাবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই খাবার সাধারনত সয়াবিন, মটরশুঁটি ছাড়াও অন্যান্য উদ্ভিদজাতীয় খাবার দিয়ে তৈরি করা হয়। এগুলোতে সাধারণত আমিষ এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ঠিক রেখে মাংসের মতো স্বাদ যোগ করা হয় যাতে খেতে গরুর মাংসের মতো হলেও আসলে মাংস না। বাচ্চার পরিবার ভেজিটেরিয়ান বা ভিগান হলে শিশুর আমিষের চাহিদা মেটাতে প্ল্যান্ট-বেইজড মিট ভালো সমাধান হতে পারে। তবে যেহেতু এই ধরনের মাংস বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা হয়, এতে প্রিজারভেটিভ আর অতিমাত্রায় সোডিয়াম থাকে৷ বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন সেগুলোতে প্রিজারভেটিভ আর সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি না থাকে।
বাচ্চাকে গরুর মাংস দিলে খাওয়ার সময় গলায় আটকে যেতে পারে
গরুর মাংস একটু শক্ত হওয়ার খাওয়ার সময় বাচ্চার গলায় আটকে যেতে পারে। বিশেষত কিমার তুলনায় মাংসের আস্ত টুকরা গলায় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বাচ্চার খাদ্যনালী প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় চিকন হওয়ায় গরুর মাংস গলা দিয়ে নামতে একটু কষ্ট হতে পারে। তবে শুনতে ভয়ংকর শোনা গেলেও, আপনার দুশ্চিন্তার খুব একটা কারণ নেই৷ বাচ্চার বয়স অনুযায়ী ভালোভাবে রান্না করে দিলে চাবাতে সুবিধা হয় আর গিলতে বেশি সমস্যা হয়না। আর যদি গিলতে গিয়ে আটকেও যায় গ্লাস বা কাপ দিয়ে পানি খাইয়ে দিন।
যদি একদমই গলা দিয়ে নামার মতো না হয় বাচ্চার খাদ্যনালী নিজেই মাংসটা সামনের দিকে ঠেলে মুখ দিয়ে বের করে দেবে। খাবার বের করতে বাচ্চার সাহায্য লাগবে মনে হলে তাকে একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে থুতনির নিচে হাত দিয়ে খাবার বের করে ফেলার ইঙ্গিত দিন। তবে সাহায্য করতে গিয়ে বাচ্চার মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দেবেন না, এতে খাবার আরো ভেতরের দিকে গিয়ে আটকে যেতে পারে। আর কোনোভাবেই যদি গলা না খোলে তাহলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে যান।
গরুর মাংস খাওয়ানোর সময় বাচ্চার আশেপাশেই থাকুন যাতে যেকোনো পরিস্থিতি সামলানো যায়।
বাচ্চাকে গরুর মাংস কিভাবে খাওয়াতে হবে
গরুর মাংস খাওয়ানোর ক্ষেত্রে ৬-৮ মাস বয়সী বাচ্চাদেরকে ছোট টুকরা দেয়া উচিত না কারণ তারা গলায় আটকে ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে ওদেরকে বড় এক টুকরা মাংস দিতে হবে যাতে বাচ্চা সেটায় কামড়ে কামড়ে মাংসের স্বাদ নিতে পারে। বয়স ৯ মাস পার হলে একদম ছোট ছোট টুকরা করে মাংস দেয়া যেতে পারে। এতোদিনে তার চাবানোর দক্ষতা বেড়ে যাওয়ায় ছোট টুকরার মাংস সহজেই চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করতে পারবে। বাচ্চার দেড় বছর পূর্ণ হলে স্বাভাবিক চাবানোর মতো টুকরা করে দিতে হবে যেটা নিজেই হাতে ধরে প্রয়োজনমতো চিবিয়ে খেতে পারে।
রেফারেন্স:
- Centers for Disease Control and Prevention. (2022). Salmonella and ground beef.
- Department of Health & Human Services. (2022). Cook to a safe minimum internal temperature
- FAO WHO. (2018). Shiga toxin-producing Escherichia coli (STEC) and food: attribution, characterization, and monitoring. Microbiological risk assessment series. 31.
- Department of Health & Human Services. (2022). Cook to a safe minimum internal temperature.
- Centers for Disease Control and Prevention. (2022). Salmonella and ground beef.
- American College of Asthma, Allergy, & Immunology. Meat Allergy.
- Johns Hopkins Medicine. Milk allergy diet.