এ আর্টিকেলে যা থাকছে
অনেক শিশুই কিছু নির্দিষ্ট খাবার খেতে চায়না। এই খেতে না চাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে।শিশুর খেতে না চাওয়া দু ধরনের হতে পারে।
এক. নতুন কোনো খাবার খেতে না চাওয়া অথবা
দুই. আগে যে খাবারটি পছন্দ করে খেতো সেটি আর খেতে না চাওয়া।
দুইক্ষেত্রেই শিশুর মধ্যে একটা ভয়ের অনুভূতি বা ফিয়ার রেসপন্স লক্ষ্য করা যায়। খাবারের প্রতি ফিয়ার রেসপন্স বা ভয়ের অনুভূতি শিশুর বেড়ে ওঠার একটা স্বাভাবিক অংশ। বেশিরভাগ শিশুই খাবারের প্রতি এই ফিয়ার রেসপন্স বা ভয়ের অনুভূতি অনুভব করে। বিশেষত দুই বছর কিংবা তার কাছাকাছি বয়সে শিশুরা এটি সবচেয়ে বেশি অনুভব করে।
যে খাবারগুলো একটু ‘অন্যরকম’ দেখতে, সে খাবারগুলো খেয়ে দেখতে না চাওয়ার মাধ্যমে শিশুরা তাদের এই ভয়টা প্রকাশ করে। অন্যরকম বলতে এমন খাবারকে বোঝানো হচ্ছে যে খাবারের রং, আকার অর্থাৎ খাবারটি যেমন দেখতে তার সাথে শিশু পরিচিত না। শিশুদের যে খাবার দেওয়া হয়, তারা সেগুলো খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করে।
শিশুরা তাদের মাথায় ‘নিরাপদ’ খাবারের একটা ধারণা তৈরি করে। তাই এমনও হতে পারে, শিশু যে খাবারটি আগে খেতে পছন্দ করতো এখন হয়তো সে খাবারটা খেতে চাইছেনা কারণ তার ‘নিরাপদ’ খাবারের ধারণার সাথে সেই খাবারটা মিলছেনা। শিশু কোনো একটি খাবার খেতে না চাইলে আপনাকে জানাবে যে সে খাবারটি পছন্দ করছেনা অথবা তাকে অল্প একটুও জোর করে খাওয়াতে চাইলে সে খাবারের প্লেটটি সরিয়ে দিতে পারে এমনকি কান্নাকাটিও করতে পারে। এছাড়া কোনো খাবার খেয়ে দেখার পর স্বাদ পছন্দ না হলে কিংবা খেতে তিতা লাগলে শিশুরা খাবারটি খেতে চায়না। সবজি যেহেতু কিছুটা তেতো স্বাদের হয়, এজন্যেই বেশিরভাগ শিশু সাধারণত সবজি খেতে চায়না।
কেন শিশুরা প্রায়ই খেতে চায়না?
নতুন খাবারের প্রতি ভয় (food neophobia) আমাদের শরীরের একটি সহজাত প্রক্রিয়া। মনে করা হয়, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন শিকার করে খেতো তখন এই নতুন খাবারের প্রতি ভয়টাই তাদের কোনো বিষাক্ত খাবার খেয়ে ফেলা থেকে সাবধান করতো। এইভাবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি খাবারের গন্ধ, রং এবং খাবারটা খাওয়ার পর তাদের কেমন লেগেছে অর্থাৎ, খাবারটা খেয়ে তারা অসুস্থ হলো কি হলো না তার ভিত্তিতে কোন খাবার খাওয়া যাবে এবং কোন খাবার খাওয়া যাবেনা তা বুঝত।
যেমন একটা আপেলের রং লাল অথবা সবুজ হলে, খেতে মিষ্টি হলে বুঝতে হবে সেটি ভালো। অন্যদিকে, বাদামী রং এবং তেতো স্বাদের হলে বোঝা যায় সেটি খাওয়া যাবেনা। অর্থাৎ, আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিরাপদ খাবার চেনার জন্য খাবারের রং, গন্ধ এবং স্বাদের ওপর নির্ভর করত। যদিও এই ধারণাটিই তেতো স্বাদের শাকসবজি খাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এই কারণেই শিশুদের ভালো, নিরাপদ খাবার দেওয়া হলেও তারা খাবারটি নিশ্চিন্তে খেতে পারেনা।
বাবা মায়ের ভূমিকা কী
বাবা-মা সহ যারা শিশুর যত্ন নেন তাদের শিশুর এই খাবার নিয়ে অনিশ্চয়তা কমাতে সাহায্য করতে হবে। শিশুকে নতুন খাবার খেয়ে দেখতে উৎসাহ দিতে হবে। শিশুকে সাহায্য করতে অবশ্যই আগে বুঝতে হবে যে একটা বয়সে শিশু নতুন খাবার কিংবা আগে খেতে পছন্দ করতো এমন খাবার এর স্বাদ, রং, গন্ধ ইত্যাদি বিবেচনা করে এখন নাও খেতে চাইতে পারে। এক্ষেত্রে শিশুর খাবারের বিষয়টা তার মত করে দেখার চেষ্টা করতে হবে।
ধরুন কোন শিশু ৬ মাস বয়সে কলা খেতে পছন্দ করত। সে একই শিশু ১ বছর বয়সে কলা খেতে একেবারেই পছন্দ না করতে পারে। এক্ষেত্রে জোরাজুরি না করে কয়েকদিন কলা খেতে না দেয়াই ভালো।৫/৭ দিন পরে কলা দেয়া যেতে পারে। আবার কলা দিয়ে তৈরি পিঠা বা কেক দিয়ে দেখা যেতে পারে।
যে নির্দিষ্ট খাবার শিশু খেতে চায় না সেটি বাবা মা খেয়ে শিশুকে উৎসাহ দিতে পারে।
খেতে না চাওয়া খুব স্বাভাবিক
স্বাভাবিক হলেও শিশুর খেতে না চাওয়ার বিষয়টা অবহেলা করা উচিত নয়। শিশুর খেতে না চাওয়ার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব তিনটি উপায়ে–
১.উৎসাহ দিন
২.ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা করুন
৩.খাবারের প্রতি ভালোলাগা তৈরি করুন
যে খাবারটি শিশু খেতে চায়না সেটা বারবার শিশুর সামনে এনে দিন, এতে শিশু খাবারটার গন্ধ, রং, আকারের সাথে পরিচিত হতে শুরু করবে এবং এক পর্যায়ে খেতে রাজিও হতে পারে। শিশুর খেতে না চাওয়ার বিষয়টা অবহেলা করা হলে, হয়তো শিশু বড় হয়েও ঐ খাবারটা কখনোই খেতে চাইবেনা যার কারণে তার শরীরে ভিটামিন, মিনারেলের অভাব থেকে যেতে পারে।
কিভাবে চেষ্টা করা যেতে পারে
শিশুকে সাহায্য করার জন্য শুরুতেই বুঝতে হবে শিশু কোনো একটি “নির্দিষ্ট” খাবার খেতে চায়না কারণ সে খাবারটি কেমন দেখতে, তার গঠন, রং ইত্যাদির সাথে সে পরিচিত না। তাই শিশু খাবার বাছে এমন না ভেবে শুরুতেই মেনে নিন এই খাবারের প্রতি ভয়ের অনুভূতিটা খুব স্বাভাবিক এবং এটা সব মানুষের মধ্যেই রয়েছে।
যে কোনো ভয় কাটানোর সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো, যে জিনিসটা শিশু ভয় করে সে জিনিসটাকে অল্প অল্প করে ধীরে ধীরে তার সাথে পরিচিত করা। শিশুকে নতুন খাবার কিংবা আগে পছন্দ করতো এমন খাবার খেতে উৎসাহ দিতে একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। দেখা গেছে শিশুকে বারবার একটা খাবার দেখালে, খেতে দিলে শিশুর সেই খাবারটি খেয়ে দেখার ইচ্ছা এবং খাবারটির প্রতি ভালো লাগা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
এমনকি শিশুরা তিতা খাবার জন্ম থেকেই অপছন্দ করলেও বারবার শিশুকে তিতা খাবার খেতে দিলে শিশু ধীরে ধীরে সেটাও পছন্দ করতে শুরু করে। তাই শিশু কোনো একটি খাবার খেতে না চাইলে, তাকে খেতে জোর না করে বরং বারবার বিভিন্ন সময়ে খাবারটি খেতে দিন অথবা সামনে রাখুন।
অর্থাৎ শিশুকে যত বেশি খাবারটি দেওয়া হবে, দেখানো হবে, চেনানো হবে শিশু তত বেশি খাবারটির সাথে পরিচিত হতে শুরু করবে, খাবারটির প্রতি তার ভয় কমতে থাকবে এবং একসময় সে খাবারটি খেতে রাজি হবে এমনকি পছন্দ ও করতে শুরু করবে।
কয়েকটি টিপস
ধৈর্য্য রাখুনঃ শিশুকে কোনো একটা খাবার মুখে নিতে ইচ্ছুক করার জন্য ১৫ থেকে ২০ বার তার সামনে খাবারটি আনতে কিংবা তাকে খেতে দিতে হতে পারে। তাড়াহুড়া করবেন না। শিশুকে বারবার খাবারটি খেতে দিতে থাকুন এবং অন্তত ২০ বার শিশুকে খাবারটি খেতে দেওয়া ছাড়া হাল ছাড়বেন না।
একই খাবার বিভিন্নভাবে খেতে দিনঃ আপনি কী উপায়ে শিশুকে খাবারটি খেতে দিচ্ছেন তা নিয়ে ভেবে দেখুন। খাবার বিভিন্নভাবে রান্না বা তৈরি করা যায় এবং নানারকমভাবে খেতে দেওয়া যায়। শিশু হয়তো কোনো একটা ধরনে খাবারটা পছন্দ করছে না কিন্তু অন্যভাবে দিলে পছন্দ করতেও পারে। যেমন ধরুন,এমিল ডিম খায় না কিন্তু ডিম-দুধ-দারচিনি দিয়ে করা ফ্রেঞ্চ টোস্ট দারুণ পছন্দ করে।
জোর করবেন নাঃ শিশু যদি কোনো একটি খাবার খেতে না চায় ,তাকে জোর করবেন না। শিশুকে খেতে জোর করলে নানারকম সমস্যা হতে পারে। শিশুর খাবারের অবস্থার উন্নতি লক্ষ্য করলে তাকে উৎসাহিত করুন। যেমন যে সবজিটা সে আগে খেতে চায়নি, সেটা আগ্রহ করে অল্প পরিমাণ খেলেও তার প্রশংসা করুন। খেয়াল রাখবেন, পুরোটা খেয়ে শেষ করার জন্য যেন তাকে চাপ না দেন বা জোর না করেন।অন্যভাবে চিন্তা করুনঃ শিশুকে অনেক উপায়েই যে খাবারটি সে খেতে চাইছেনা তার সাথে পরিচিত করা যায়। শুধুমাত্র খাওয়ার সময়েই খাওয়ার জন্য শিশুকে খাবারটি দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেকোনো সময়েই খাবারটিকে দেখা কিংবা খাবারটির সাথে যেকোনো ধরনের যোগাযোগই খাবারটির সাথে শিশুর পরিচয় বাড়াতে থাকে। যার ফলে এক পর্যায়ে শিশুর খাবারটি খেয়ে দেখার প্রতি আগ্রহী হয়। খাবার, খাবার তৈরি করা , রান্না ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায় এমন খেলাধুলা, খাবার সম্পর্কে পড়া , খাবার নিয়ে গান করা এসবের মাধ্যমেও শিশুকে খাবারগুলোর সাথে পরিচয় করানো যায়।
এই লেখাটি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অ্যাস্টন ইউনিভার্সিটি ও লাফব্রা ইউনিভার্সিটির গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে।
Thank you