খাবার ছুঁড়ে ফেলা বাচ্চাদের খুবই সাধারণ একটি অভ্যাস। একেক বয়সে শিশু একেক কারণে খাবার ছোঁড়াছুড়ি করে।
সাধারণত ৬ মাস বয়সী বাচ্চা খাবার ছোঁড়ে খাবারটি কোথায় পড়ছে, কিভাবে পড়ছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য। কোনো বস্তু উপরের দিকে বা সামনে ছুঁড়লে যে সেটা নিচের দিকেই পড়বে (বিজ্ঞানের ভাষায় এটা মাধ্যাকর্ষণ বা গ্র্যাভিটি) এই বিষয়টিই ৬ মাসের শিশুর জন্য মূল আকর্ষণ।
আবার ৯ মাসের শিশু কোনো খাবারে এক কামড় দিয়েই ফেলে দিতে পারে, এভাবে খাবারটি দিয়ে সে ‘টস’ খেলে, অর্থাৎ খাবারটি কিভাবে নিচে পড়ছে তা দেখে।
১২ মাস বয়সী খাবার নিয়ে খেলার আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সামনের দেয়ালে, চেয়ারের নিচে এমনকি নিজের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় টপাটপ করে লাগিয়ে দেখতে পারে কেমন আওয়াজ হয়, দেখতে কেমন লাগে!
অবশ্য অনেক বাচ্চা শুধুমাত্র না খাওয়ার জন্যই খাবার ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মানে ওটা সে খাবে না। বা তার তখন খিদেই নেই।
খাবার ছুঁড়ে ফেলা নিয়ে বাবা-মার জন্য ভালো-খারাপ দুই ধরনের সংবাদই আছে।
🙁 খারাপ খবরটি হচ্ছে- শিশুর খাবার ছুঁড়ে ফেলার এই প্রবণতা অনেকদিন থাকতে পারে এবং দিন দিন আরো বাড়তে পারে।এজন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
😀 ভালো খবরটি হচ্ছে- আপনি শিশুর খাবার ছুঁড়ে ফেলার প্রবণতাকে কমিয়ে আনতে পারবেন। আপনাকে নিজের রাগ সামলাতে হবে এবং শিশুকে সঠিকভাবে গাইড করতে হবে।
এ আর্টিকেলে শিশুর খাবার ছুঁড়ে ফেলার অভ্যাস কিভাবে কমানো যায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সমাধানগুলি আমি কিভাবে কাজে লাগিয়েছি তা উদাহরণসহ আলোচনা করব।
বয়সভেদে মনোবিজ্ঞানের কৌশলগুলি আলাদা। তাই এ গাইডলাইনকে আমরা দুইভাগে ভাগ করেছি। একটি ৬-১১ মাস বয়েসী শিশুর জন্য, আরেকটি আরেকটু বড় শিশু বা ১২-২৪ মাস বয়সী শিশুর জন্য।
বাচ্চা কেন খাবার ছুঁড়ে ফেলে (৬ মাস থেকে ১১ মাস বয়স)
শিশুর যে কোনো আচরণে যদি আপনি পরিবর্তন আনতে চান, তবে প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে শিশু কেন এমন আচরণ করছে।
বেশিরভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই, খাবার ছুঁড়ে ফেলা আসলে তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার অংশ। কেননা এই বয়সটাতে তারা প্রত্যেকেই এক একজন ক্ষুদে বিজ্ঞানী। তাদের জন্য সব কিছুই আবিষ্কার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের বিষয়। কোথাও খাবার রাখা কিংবা ছুঁড়ে ফেলা –বাহ, দুটোতেই তো মাধ্যাকর্ষণ আবিস্কার করা যায়! এ যেন শিশুর জন্য এক মজার খেলা। একে ইংরেজিতে বলে cause and effect, বাংলায় বলতে পারেন যেমন কর্ম, তেমন ফল।
আবার কোনো কোনো শিশু খাবার বা স্বাদের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে পারে না বা পছন্দ করতে পারে না বলে খাবার ফেলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে খাবার ছুঁড়ে ফেলার কারণ খুঁজে বের করতে আপনাকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে।
খেয়াল করে দেখুন তো–
আপনার বাচ্চার কি পেট ভরে গিয়েছে?
সে কি খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে? নাকি সে অন্য কোনো খাবার খেতে চাইছে?
সাধারণত শিশুদের আমরা যেসব খাবার দেই যেমন- মিষ্টি দই, মিষ্টি জেলী/জ্যাম/ক্রীম/চীজে পূর্ণ ফোলা খাবার বা পাফ, গলে যাওয়া দই, মিষ্টি কুকিজ, অথবা মিষ্টি পিউরিজাতীয় খাবার এগুলি সব শিশু পছন্দ করে না। আবার সবসময় একই খাবার খেলে বিরক্ত লাগাই স্বাভাবিক।
আসল কারণটি খুঁজে বের করতে পারলেই এই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা আপনার জন্য সহজ হবে।
খুব সাধারণ দুটি কারণ নিয়ে আলোচনা করা যাক–
১. বাচ্চার ক্ষুধা লাগেনি
খাবার ছুঁড়ে ফেলার ৯০ ভাগ ঘটনা ঘটে তখন যখন বাচ্চার ক্ষুধা লাগার আগেই বাবা-মা তাকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা হল যখন ক্ষুধা লাগে তখন খাবার দিলে খাবার নিয়ে খেলা করা বা নষ্ট করার মত কাজে বাচ্চারা সময় নষ্ট করে না। বরং দ্রুত খেয়ে নেয়।
যেসব বাবা-মা ঘড়ি ধরে (কিংবা অন্যের রুটিন অনুসারে) বাচ্চাকে খাবার দেন, তারা এ খাবার ছুঁড়ে ফেলার ঘটনা বেশি দেখেন কারণ বাচ্চার ক্ষুধা নির্দিষ্ট সময় পরে নাও লাগতে পারে। (এবং সে বুকের দুধ বা ফরমুলা খেয়ে পেট ভরে রাখতে পারে)
সাধারণত ক্ষুধা না পেলে বাচ্চারা খাবার মুখে দিতে চায় না। অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকার পরেও কেন তার ক্ষুধা লাগছে না সেটা বোঝা খুব জরুরি ।
বাচ্চা কি বয়সের তুলনার বেশি পরিমাণে বুকের দুধ বা ফর্মুলা দুধ পান করে ফেলছে?
সে কি খুব ঘন ঘন খাচ্ছে?
সে কি স্ন্যাকসজাতীয় খাবার (চিপস, চকলেট, বিস্কুট) খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলছে?
ভালো করে শিশুর খাবারের রুটিনটি লক্ষ্য করুন এবং প্রয়োজন বুঝে এমনভাবে পরিবর্তন করুন যেন শিশুর ক্ষুধা পায়। অন্যের রুটিন দেখে নয়, নিজের শিশুর চাহিদা বুঝে রুটিন বানান। হতে পারে শিশু ২ ঘণ্টা পরপর খেতে চায় না। ও আরো আগে বা পরে চায়। আবার হতে পারে আপনি ওকে যে নরম মিষ্টি খাবার দিচ্ছেন সেটা ওর ভালো লাগছে না। ও হয়ত শক্ত খাবার কিংবা ভিন্ন স্বাদের খাবার চায়।
তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে সলিড খাবার আগে শিশু যেন খুব বেশি ক্ষুধার্তও না থাকে। তাহলে সে মেজাজ গরম করেও খাবার ছুঁড়ে ফেলতে পারে।
এক্ষেত্রে একটি ভালো সমাধান হল, শিশুকে সলিড খাবারের আগে অল্প পরিমাণে বুকের দুধ বা ফরমুলা খাইয়ে পেটে ক্ষুধা রেখেই সলিড খাবার দেয়া। সলিড খাবারের পর আবার অল্প দুধ খাওয়ানো। তাহলে বাচ্চা সলিড খাবারের সময়ে বেশি ক্ষুধার্তও থাকবে না, আবার তার পেট ভরেও যাবে না।
২. খেতে শিশুর কষ্ট হয় হচ্ছে (যারা শিশুকে নিজের হাতে খেতে দেন)
বাচ্চা ছোট, তাই খাবারগুলি আমরা এমনভাবে টুকরো করি যেন ছোট ছোট হয়। আসলে কি জানেন! বাচ্চার ধরা ও খাওয়ার সুবিধা হয় খাবারের টুকরো বড় হলে! যেমন ধরুন তরমুজ কিংবা কমলা–আপনি যত বড় টুকরো করে ওর হাতে দেবেন, ততই ওর খাওয়ার আরাম হবে।
শিশুরা সাধারণত এমন খাবার ফেলে দেয় যেটা তোলা বা ধরে রাখা ওর কষ্টকর। বা চিবানোও কঠিন। খাওয়া কিন্তু ওর জন্য বেশ কঠিন কাজ। শিশুকে দেয়া খাবারের আকার–আকৃতি ভালোভাবে লক্ষ করুন। ওই খাবারটি ঠিকভাবে তোলা, ধরা এবং মুখে ঢোকানোর জন্য টুকরোগুলো খুব বেশি ছোট হয়ে যায় নি তো?
কিছু বাচ্চা অবশ্য এই কঠিন কাজটিকেই একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়, তবে অধিকাংশ শিশুই দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হতাশ হয়ে প্লেট খালি করার জন্য মেঝেতে খাবার ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করে। এমনকি যেসব শিশুরা চ্যালেঞ্জ ভালোবাসে, তারাও কখনও কখনও চেষ্টা চালিয়ে যাবার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে।
খাবার ছুঁড়লে কিভাবে বন্ধ করবো (বয়স ৬-১১ মাস)
সবার আগে মনে রাখবেন, বাচ্চার খাওয়ার সময়টি যেন ভয়ের না হয়, আনন্দের হয়।শিশুর সলিড খাবার শুরু করার সময়ের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক বা পজিটিভ হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার দেয়া খাবারটি বাচ্চা খেতেও পারে, আবার নাও খেতে পারে। ফলাফল যেটাই হোক, আপনি শান্ত আচরণ করুন, সহজভাবে মেনে নিন।
বাচ্চাকে তিরস্কার করলে, নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলে, কিংবা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলে হিতে বিপরীত হয়।
১. শান্ত থাকুন
শিশুর ছুঁড়ে ফেলা খাবারটি এক মিনিটের জন্য মেঝেতেই পড়ে থাকতে দিন। প্রথমেই তুলে ফেলবেন না। যেন ও এই ঘটনাটির কারণ ও প্রভাব বুঝতে পারে। অর্থাৎ খাবার ফেলে দিলে সেটা যে টেবিল থেকে দূরে চলে যায় –এটা তাকে বুঝতে দিন। এক মিনিট পর কোনো ধরনের আবেগ (রাগ/ক্ষোভ/জেদ/হতাশা) না দেখিয়ে তাকে বলুন, “তোমার খাবারটি কি মেঝেতে পড়ে আছে? খাবার ছুঁড়ে ফেললে এমনটাই ঘটে থাকে, খাবারটা মেঝেতে পড়ে যায়। চল এবার খাবারটা মেঝে থেকে প্লেটে তুলে আনি, কারণ খাবার হলো টেবিলে থাকার জিনিস, প্লেটে থাকার জিনিস, মেঝেতে নয়।’’
২. ছুঁড়ে ফেলা খাবার দুই-তিনবার ওঠান
ফেলে দেয়া খাবারটি তুলে নিয়ে আবার ওকে খেতে দিন। যদি সেটা খাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিস্কার থাকে সেটাই দেবেন, নাহলে নতুন খাবার (একই আইটেম) দিন যেন শিশু আবারো চেষ্টা করতে পারে। শান্তভাবে তাকে বার বার মনে করিয়ে দিন যে, খাবার হলো টেবিলে থাকার জিনিস।প্লেটে থাকার জিনিস। ফেলে দেয়া খাবারটিকে এভাবেই দুই বা তিনবার ওঠাবেন।
তিনবারের বেশি তুলবেন না।
কারণ তখন সে এটাকে একটা খেলা মনে করবে। যে খেলার নাম, ‘আমি ফেলব-তুমি তুলবে’। ভুলেও এসব খেলায় অংশগ্রহণ করতে যাবেন না। খাবার নিয়ে কখনোই যেন খেলা না হয়। তাহলে পরে আপনিই বিপদে পড়বেন।
আবার বারবার খাবার তুলে বাচ্চাকে দিলে ও চাপ বোধ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ওর খাবারের প্রতি অনাগ্রহ চলে আসবে।
তাহলে কী করবেন? কেন এমন করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। যদি শিশু খাবার ছুঁড়ে ফেলে, চোখ ঘষাঘষি করে এবং তাকে যদি ক্লান্ত দেখায় তাহলে বুঝে নিন যে বাচ্চা আর খাবে না।
শান্তভাবে তাকে বলুন, এরপর থেকে তুমি আর না খেতে চাইলে আমাকে বলবে।
হাত বন্ধ করে দেখিয়ে বলুন (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ), বলবে যে মা আমার খাওয়া শেষ। আমি আর খাব না। এভাবে ছুঁড়ে ফেলবে না কেমন?
তারপর হাসিমুখে এ বেলার খাওয়া পর্ব শেষ করুন। মানে ওর হাত মুখ মুছে দিন।
৩. দেখাতে দেখাতে বলুন
কিছু বাচ্চাকে শুধু মুখে বললে হয় না, সেইসাথে দেখাতেও হয়। শিশুর পাশে দাঁড়ান এবং খাবার ছুঁড়ে ফেলার সময় তার হাতটি আস্তে করে ধরে তাকে বাধা দিন (সে যেন ব্যথা/ভয় না পায়)। আপনার হাত সহ তার নিজের হাতেই খাবারটিকে টেবিলে ফিরিয়ে আনুন। সেই সাথে শান্তভাবে তাকে বলুন, “খাবার হলো টেবিলে থাকার জিনিস”। এই কথাটি বলার মাধ্যমে আপনি শিশুকে আপনার কথাটি বোঝাতে সাহায্য করবেন। আপনি যেটা বলছেন সেটা বলতে বলতে ওকে করে দেখালে ও আরো ভালোভাবে নির্দেশনাটি বুঝবে।
মনে রাখবেন, পুরো ব্যাপারটি যেন খেলার ছলে বা আনন্দের সাথে হয়। ভুলেও শিশুকে জোরজবরদস্তি, ধমকাধমকি বা উচ্চস্বরে নির্দেশনা দেবেন না।
শিশু কেন খাবার ছুঁড়ে (বয়স ১২ থেকে ২৪ মাস)
১২-২৪ মাস বয়সী শিশুর জন্য ইংরেজিতে একটা সুন্দর নাম আছে। ওরা এখন আর ‘বেবি’ নেই।এখন ওদের নাম টডলার। এবং এখন ওরা যেসব কাজ করে তার উদ্দেশ্য লক্ষ্য আগের চেয়ে আলাদা।
টডলার কেন খাবার ছুঁড়ে ফেলে এর উত্তরটি বেশ জটিল। এই বয়সের বাচ্চাদের খাবার ছুঁড়ে ফেলার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।
১. পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে (এক্সপেরিমেন্ট)
হতে পারে বাচ্চার খাবার ছুঁড়ে ফেলাটা কোনো বাজে অভ্যাস নয়, বরং সে খাবারটি উড়ে কিনা তা দেখতে চাইছে। হয়তো সে মাত্রই আবিস্কার করে ফেলেছে যে, মেঝে জুড়ে খাবার ছুঁড়ে ফেলার প্রক্রিয়াটি কতো চমৎকার। এ ঘটনার মাধ্যমে এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী আসলে কারণ, প্রভাব ও মাধ্যাকর্ষণের ধারণাটি শিখছে এবং উপভোগ করছে। সেই সাথে সে এটাও জানতে চায় যে, প্রতিবার বা প্রত্যেক খাবারের বেলায় একই ঘটনা ঘটে কিনা। যেমন, মাংস আর পাউরুটি একইভাবে, একই স্পিডে নিচে পড়ে?
২. নিছকই মজার খেলা
অধিকাংশ বাচ্চাই খাবার নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। খাবারকে চ্যাপ্টা করে ভর্তা বানানো, এদিক-ওদিক খাবার লেপে দেয়া বা মাখানো এবং খাবারটিকে ছুঁড়ে ফেলা –এ সবই শিশুর বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন গঠনের খাবার সম্পর্কে ধারণা লাভের অংশ। খাবার নিয়ে এ ধরনের খেলা বাচ্চার জন্য প্লে-ডো নিয়ে খেলার চেয়েও বেশি মজাদার হয়ে থাকে। প্লে ডো হলো কাদামাটির মত প্লাস্টিকের নরম জিনিস যা আটা ময়দা বা কাদার বদলে শিশুদের দেয়া হয়।
৩. খেতে চায় না
১২ থেকে ২৪ মাস বয়সী শিশুর খাবার নিয়ে বিরক্তি, অপছন্দ কিংবা অনীহার বিষয়টি বোঝানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে খাবার ছুঁড়ে ফেলা। ধরুন সে খেতে চায় না, তার ক্ষুধা লাগেনি বা যেটা খেতে দেয়া হয়েছে সেটা তার পছন্দ হয়নি–সে নির্দ্বিধায় খাবার ছুঁড়ে মারবে।
৪. মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা
বাচ্চা খাবার ছুঁড়ে ফেলামাত্র আপনি কি চেঁচিয়ে ওঠেন– না, না, না! নিজের প্লেটের খাবার ছুঁড়ে ফেলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে হয়তো আপনার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাই করছে ও! আপনি হয়তো মলিনভাবে হাসবেন, অথবা বিরক্ত হবেন, অথবা হতাশ হবেন –এসব প্রতিক্রিয়ার কোনো একটি দেখালেই আপনার বাচ্চার উদ্দেশ্য সফল হবে। অর্থাৎ সে আপনার মনোযোগ পাবে।
৫. অনিয়ন্ত্রিত আবেগ বা জেদ
এ বয়সী শিশুরা, বিশেষ করে ২ বছরে, প্রায়ই নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।বাচ্চারা চোখের সামনে যা দেখে সেটাই স্পর্শ করতে, খোঁচা দিতে, মুঠির ভেতর আটকে ফেলতে ও ছোঁড়াছুঁড়ি করতে চায়। চাইলেও নিজের এ ইচ্ছাকে সে দমন করতে পারে না। কারণ এই বয়সের শিশুদের সাধারণত নিজেদের আবেগের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
খাবার ছুঁড়লে কিভাবে বন্ধ করবো (বয়স ১ বছর+)
কেন খাবার ছুঁড়ে ফেলে সেটা নাহয় বুঝলাম, এখন এ ব্যাপারে কী করা যায়? ঘাবড়াবেন না, ধৈর্য্য ধরে কিছু টিপস অনুসরণ করুন। আপনি হয়ত তার এই অভ্যাস একেবারেই বন্ধ করতে পারবেন।
- প্লেটে অল্প খাবার দিন বাচ্চার প্লেটে যত বেশি খাবার থাকবে, তত বেশি সে খাবারগুলো নিয়ে খেলতে চাইবে। তাই একবারে বেশি খাবার না দিয়ে অল্প কয়েক টুকরো বা অল্প পরিমাণে খাবার দিন। সামনে রাখা খাবারটি শেষ হলে আরও কয়েক টুকরো খাবার তার প্লেটে দিন।বাচ্চাদের এমনিতেও খুব বেশি পরিমাণ খাবার সামনে দেবার প্রয়োজন হয় না। বিশেষ করে প্রতিবার যদি নতুন নতুন খাবার তার সামনে দেয়া হয়, তাহলে তার খাওয়ার আগ্রহ বেড়ে যায়। এমিলের জন্য যখন খাবার নেই তখন আমি কাঁচের বাটিতে গরম খাবারটি নেই। এবং ওর সিলিকনের বাটিতে অল্প একটু করে করে ওর সামনে দেই। সেটা খাওয়া হলে কাঁচের বাটি থেকে আবারও অল্প একটু খাবার নিয়ে ওর বাটিতে দেই। যদি নানারকম আইটেম থাকে, ধরুন-টমেটো, ঢেঁড়স আর ভাত, তাহলে একবার টমেটো আরেকবার ঢেঁড়স দিয়ে ভাত দেই। এতে ও খেতেও আগ্রহী হয়।
- চামচে নিয়ে খেতে দিন গলা খিচুড়িতেও আমি বড় বড় করে সবজি কেটে দেই। যেন খাওয়ার সময় সেদ্ধ মিষ্টি কুমড়া, গাজর বা আলু ওকে নিজের হাতে বা চামচে খেতে দিতে পারি। বাচ্চাদের জন্য ভালো কাটা চামচ কিনতে পাওয়া যায়। কিনতে না পারলে প্লাস্টিকের কাটা চামচই ওর হাতে দিয়ে খাবারটি ধরতে, তুলতে শেখান। ও যদি এ কাজে ব্যস্ত থাকে তাহলে খাবার ছোঁড়াছুড়ি করবে কম। আবার খাবারটি একটু অন্যভাবে খেতে পেরে আনন্দ ও আগ্রহ দুটোই বেশি পাবে।
- শিশুর পুতুলকে খাওয়াতে দিন
ভিডিওতে নিশ্চয়ই দেখেছেন, খাওয়ার সময় এমিলের খেলনা কুকুরকে ওর পাশে বসিয়ে রাখি। খাওয়ার সময় আমি ওর কুকুরকে খাইয়ে দিতে বলি। অনেক সময় আমি নিজেও কুকুরকে খাইয়ে দেয়ার ভান করি। এতে খাবারটি ছুঁড়ে ফেলার আনন্দের চেয়ে আরেকজনকে দেয়ার কাজে বাচ্চা বেশি ব্যস্ত থাকে। এটা একটা উদাহরণমাত্র। আপনি খাওয়ার সময় খাওয়া কেন্দ্রিক কোনো খেলা ওর সাথে খেলতে পারেন। যেমন ধরুন মুড়ি খাওয়ার সময় দুটো মুড়ি ওর বাটিতে দিয়ে নেড়ে দেখালেন। এরপর ওকে নাড়তে দিলেন!
- শিশুর সাথে একসাথে খান, অন্তত পাশে বসুন
শিশুর সাথে একসঙ্গে খেতে বসার মত ভালো কাজ আর একটিও নেই। কারণ আপনি যেভাবে খাবেন আপনার শিশু আপনাকে অনুসরণ করবে। খাবারে আগ্রহ পাবে। এবং তার জন্য সময়টি আনন্দময় হবে। অনেকসময় এটা হয়ত সম্ভব হয় না। তখন অন্তত তার সামনে বসে থাকার চেষ্টা করুন। ওকে মনোযোগ দিন। ও যেন আপনার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য খাবার না ছোঁড়ে। বরং যখন খাবার ছুঁড়ছে তখন ওকে এড়িয়ে যান। হাসবেন না বা বকা দেবেন না। স্বাভাবিক থাকুন। সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাবেন না। ওর কাণ্ডটি বসে দেখুন।
- পেট ভরে গেছে কিনা বুঝে নিন শিশুর যখন পেট ভরে যায় সে নানাভাবে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করে। সবচেয়ে ভালো প্রথম থেকেই আপনি ওকে এটা শেখানোর চেষ্টা করবেন যেন পেট ভরে গেলে আপনাকে ইশারায় বুঝিয়ে দেয়। এমিল খেতে চাইলে আমি জিজ্ঞাসা করি, খাবে? ও বলে, হুমম। কিন্তু পেট ভরে গেলে খাবারটি মুখের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়। বলে, হুমমা বা নাহ। এটা ওকে ধীরে ধীরে শিখিয়েছি। আপনি নিজেই শিশুর খাওয়ার পরিমাণ, সময় ও আগ্রহ দেখে বুঝতে পারবেন ওর পেট ভরে গেছে কিনা। আপনি বাটিতে যতটুকু খাবার দিয়েছেন সেটা ওর জন্য অতিরিক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ও খাওয়া বন্ধ করামাত্র আপনিও খাবারটি ওর সামনে থেকে সরিয়ে নিন।
- ১৮ মাস থেকে নিয়ম শেখান এএপি মনে করে ১৮ থেকে ২৪ মাসে শিশুকে নিয়ম কানুন শেখানো বা অনুসরণ করানো যায়। আপনি ১২ মাসের শিশুকেও স্পষ্টভাবে বলুন, “খাবার হলো টেবিলে থাকার জিনিস”। শিশু খাবার ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলে শান্ত ও স্পষ্টভাবে তাকে বলুন, “তোমার তো পেট ভরে গিয়েছে” এবং খাবারটি সরিয়ে ফেলুন।
- শান্ত ও স্বাভাবিক থাকুন বাচ্চা যখন খাবার ছুঁড়ে ফেলা বন্ধ করে তখন তার প্রশংসা করতে ভুলবেন না। প্রশংসার ভাষা যেন এমন না হয় যে,
‘তুমি খাবার ছুঁড়ে ফেলোনি এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ”! না এটা বলবেন না। এটাতে সে খাবার ছুঁড়ে ফেলার উৎসাহ পাবে বা ব্যাপারটি তার মনে পড়ে যাবে। বরং বলুন,
‘তুমি আজকে খুব সুন্দর করে খেয়েছ, থ্যাংক ইউ লক্ষী সোনা। খাবার এভাবেই খেতে হয়। এটাই নিয়ম।’
যখন বাচ্চা খাবার ছুঁড়ে তখন তাকে কিছুই বলবেন না। বকবেন না, চিৎকার করবেন না এবং ওর দিকে বেশি মনোযোগ দিবেন না। শান্ত ও স্বাভাবিক স্বরে বলবেন, খাবার টেবিলে থাকার জিনিস। খাবার প্লেইটে থাকার জিনিস।
- প্রস্তুত থাকুন
শিশুর ফিডিং চেয়ারের নিচে খবরের কাগজ অথবা প্লাস্টিক ম্যাট বিছিয়ে রাখুন। শিশুকে দেয়াল ও পর্দা থেকে দূরে রাখুন। শিশুর জামার হাতা গুটিয়ে দিন এবং তার গলায় বড় একটি বিব ঝুলিয়ে দিন। শিশু যেন প্লেট উলটে ফেলতে না পারে, সে জন্য নিচে সাকশন-কাপযুক্ত প্লেট শিশুর জন্য ব্যবহার করতে পারেন। যদিও আপনার ছোট্ট ইঞ্জিনিয়ার গুঁতোগুঁতি করে তার প্লেটের সাকসন-কাপ খোলার উপায় বের করেও ফেলতে পারে!
- খাবারের সময়সীমা কমান
১০-১৫ মিনিটের বেশি একবেলার খাবারে সময় দিবেন না। শিশু যদি খেতে না চায়, বাদ দিন। কিছুক্ষণ পরে আবার অফার করবেন। শিশুরা বেশিক্ষণ এক জিনিসে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। যদি খেতে না চায় বা ক্ষুধা না লাগাই খাবার ছুঁড়ে ফেলার মূল কারণ হয়, তাহলে যত বেশি সময় ওকে খাওয়াতে চাইবেন তত বেশি সময় ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে, তত বেশি জেদও করবে।
- খাবারের সময় ও পরিমাণ
শিশুকে ভালো করে খাওয়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবার দেয়া। তার মানে এই না যে ক্ষুধা লেগে তার মেজাজ চড়ে যাবার পরে তাকে খেতে দিবেন। তখন কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। এতদিনে নিশ্চয়ই আপনি বুঝে গেছেন সে কতক্ষণ পরপর ক্ষুধার্ত হয়? ক্ষুধার্ত হবার আগেই খাবার রেডি রাখবেন কিন্তু খেতে দেবেন ক্ষুধা লাগার পরে। খেয়াল করবেন, স্ন্যাকস জাতীয় খাবার যেন বেশি খেয়ে পেট ভরে না রাখে। সকাল, দুপুর ও রাতের আসল খাবারের আগে বিস্কুট, কেক, বাদাম বা যে কোনো স্ন্যাকস দেয়া বন্ধ রাখুন।
বাচ্চার খাবারের পরিমাণ নিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি ভুল করি। অন্যের ভিডিও দেখে বা মনগড়া কথা শুনে না, নিজের বাচ্চাকে খেয়াল করে তার খাবারের পরিমাণ বুঝে নিন। বয়সের সাথে সাথে অল্প করে সে পরিমাণ বাড়িয়ে দিন।
- পরিশ্রম করান
এমিল যেদিন সাঁতার ক্লাসে যায় সেদিন সবচেয়ে ভালোভাবে রাতের খাবার খায়। এর কারণ হলো সাঁতার কাটতে গেলে বেশ পরিশ্রম হয়। খাবারের আগে শিশুকে মোবাইল দিয়ে বসিয়ে না রেখে এমন সব খেলা দিন যাতে ওর পরিশ্রম হয়। যেমন বল ছুঁড়ে মারা, বল দিয়ে সারাঘর দৌড়ানো বেশ পরিশ্রমের খেলা। সে যত খেলবে তত মজা পাবে, যত পরিশ্রম করবে তত ক্ষুধা বাড়বে।
আর ক্ষুধা পাওয়াই ভালো করে খাওয়ার মূল রহস্য!
রেফারেন্স:
- The National Association of Education for Young Children( NAYEC) https://www.naeyc.org/
- American Academy of Pediatrics (AAP): https://www.aap.org
Gd