শিশুর ভালোর কথা ভেবেই শিশুকে খেতে জোর করা হয়। কিন্তু শিশুকে জোর করে খাওয়ালে উল্টো পরিণতি হতে পারে। শিশু খুব কম খেলে, ফল বা শাক-সবজির মতো স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে না চাইলে কিংবা একেবারেই না খেতে চাইলে বাবা- মা উদ্বিগ্ন হন, দুশ্চিন্তা করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন শিশুর ওজন ঠিকঠাক না বাড়লে কিংবা ওজন কমতে শুরু করলে চিন্তিত হওয়া জরুরি। তবে অন্যসব ক্ষেত্রে শিশু না খেলে বাবা মায়েরা হতাশ হন বটে, তবে শিশুর খুব বেশি ক্ষতি হয় না।
শিশুকে খাওয়ানোর নেতিবাচক কৌশল কোনগুলি
বেশিরভাগ সময়ই বাবা মা সন্তানকে খাবার শেষ করার জন্য চাপ দেন, জোরাজুরি করেন।
শিশুকে বিভিন্ন উপায়ে খেতে জোর করা হয়। যেমন-
- চাপ দেওয়া: “আমি চাই তুমি প্লেটের সবটুকু গাজর খেয়ে ফেলো”
- বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়ানো: “শুধু আর এইটুকু খাও। অল্প একটু”
- “ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল”: “ আম্মু কত কষ্ট করে রান্না করেছে না? তুমি যদি লক্ষ্মী বাচ্চা হও,তবে তুমি এক্ষুণি খাবারটা খেয়ে ফেলবে!”
- নিয়ম ব্যবহার করা: “তোমার বয়সের সমান খাও। তোমার তিন বছর বয়স, তাই তুমি তিনটা আঙুর খাবে”
- লোভ দেখানো: “তুমি যদি প্লেটের সবটুকু খাবার খেয়ে শেষ করে ফেলতে পারো তাহলে যখন খুশি খেলতে যেতে পারবে।
- শাস্তি দেওয়া: “যদি প্লেটের সব নুডুলস খেয়ে শেষ না করো, তাহলে তুমি খেলতে যেতে পারবে না”
- জোর করে খাওয়ানো: জোর করে শিশুর মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে গিলতে বাধ্য করা।
এই কাজগুলো শিশুর ভালোর কথা ভেবেই করা হলেও শিশুর ওপর উল্টো খারাপ প্রভাব পড়ে।
শিশুকে খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলে সে হয়তো কিছুটা বেশি খাবে,কিন্তু জোর করে খাওয়ার ফলে শিশুর খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হতে পারে। এক সময় সে খেতে অপছন্দ করতে পারে এমনকি একদম খেতে নাও চাইতে পারে। জোর করে খাওয়ালে শিশুর নিজের ক্ষুধা বুঝতে পারা কিংবা পেট ভরে গেলে সেটা বুঝতে পারার এবং সে অনুযায়ী খাবার খাওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। যা পরবর্তীতে শিশুটির অতিরিক্ত খাওয়া (Overeating) ও অতিরিক্ত ওজন বাড়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
শিশুকে জোর করে খাওয়ালে কী হয়
সাধারণত শিশুর ওজন কম থাকলে বাবা-মা শিশুকে বেশি বেশি খেতে বলেন এবং এক সময় খেতে জোরও করে ফেলেন। শিশুকে খাওয়ার জন্য জোর করার সময় বাবা-মা বুঝতে পারেন না তারা শিশুর ভালোর কথা ভেবে জোর করলেও, শিশুর ওপর এর উল্টো প্রভাব পড়তে পারে।
এছাড়াও খাবার নষ্ট করতে না চাওয়া থেকে এবং শিশুদের অবশ্যই তাদের প্লেট খালি করা উচিত– এই ধারণা থেকে বাবা-মা শিশুকে খেতে জোর করে থাকেন।
মাঝে মাঝে শিশুকে যে খাবারটা দেওয়া হয় সেটা পরিমাণে খুব বেশি হয়। এই খাবারটা শিশু সবটুকু খেয়ে শেষ করবে এটা আশা করাটা ভুল। যে কারণে দেখা যায় প্রতিবারই কিছুটা খাবার থেকে যায়। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে, আপনার শিশু কম খাচ্ছে না বরং তাকে পরিমাণে বেশি খাবার দেওয়া হচ্ছে।
খেতে জোর করলে শিশুর ওপর কিছু খারাপ প্রভাব পড়ে। যেমনঃ
খেতে কম পছন্দ করা
খেতে জোর করলে শিশুর যে খারাপ অভিজ্ঞতা হয় তা থেকে শিশু খাবার কম পছন্দ করতে শুরু করে। শিশুর মনে খাবার এবং এর সাথে হওয়া খারাপ অভিজ্ঞতার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। কোনো একটা খাবার শিশু যতটুকু খেতে চায় তার থেকে বেশি খেতে তাকে জোর করা হলে তার অতিরিক্ত খেয়ে ফেলার খারাপ অনুভূতি হয়। যার কারণে সে একসময় সেই খাবারটি কম পছন্দ করতে শুরু করে।
খাবার খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া
একইভাবে, কোনো একটি নির্দিষ্ট্ খাবার খাওয়ার শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা যদি খারাপ হয়, শিশুর সেই খাবারটি খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়। যেমনঃ শিশুকে প্রথমবার বাঁধাকপি খেতে দিলে হয়তো নতুন খাবার খেয়ে দেখার ভয় (natural neophobia-based response) কিংবা ক্ষুধা না থাকার কারণে সে খেতে চাইবেনা। এক্ষেত্রে যদি শিশুকে বারবার বাঁধাকপি খেতে জোর করা হয় কিংবা জোর করে শিশুর মুখে খাবারটি ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় তবে শিশুর বাঁধাকপির প্রতি একধরণের খারাপ মনোভাব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বেশি যার কারণে সে পরে কখনো বাঁধাকপি খেতে নাও চাইতে পারে।
অতিরিক্ত খাওয়া এবং অতিরিক্ত ওজন (Overeating and overweight)
খাওয়ার জন্য জোরজবরদস্তি করলে শিশুর নিজের খাবারের চাহিদা ঠিকঠাক বোঝার ক্ষমতা বিকশিত হতে পারেনা। শিশুকে অবশ্যই তার নিজের শরীরের ক্ষুধা এবং পেট ভরে যাওয়ার সিগনাল বুঝতে পারার সুযোগ দেওয়া উচিত। শিশু যখন ক্ষুধা অনুভব করে এবং খেতে খেতে ক্ষুধার অনুভূতিটা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে অনুভব করে তখন সে নিজেই বুঝতে পারে শরীরের শক্তির প্রয়োজন হলে শরীর কিভাবে সেটা জানান দেয়। অন্যদিকে যখন শরীর পর্যাপ্ত শক্তি পেয়ে যায় তখন কিভাবে খাওয়া বন্ধ করার কথা জানায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুধা বা পেট ভরে যাওয়া ইন্টার্নাল অনুভূতি (Internal Feeling) হলেও, এগুলো বাইরের অনেক কিছু দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এর মধ্যে খেতে জোর করা একটা কারণ যার জন্য শিশু তার শরীরের যতটুকু প্রয়োজন তার থেকে বেশি খাওয়ার ইচ্ছা অনুভব করতে পারে।
একসময় পেট ভরে গেলেও তা শিশুর শরীরে খাওয়া বন্ধ করার সিগনাল পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ফলে পেট ভরে যাওয়া ব্যাপারটার গুরুত্বই হারিয়ে যায়। বরং খেতে জোর করলে শিশুরা পেট ভরে যাওয়ার পরেও প্লেট খালি না হওয়া পর্যন্ত কিংবা তাদের বাবা-মা না বলা পর্যন্ত খাওয়া চালিয়ে যেতে শেখে।
অর্থাৎ শিশুর নিজের শরীরের খাবারের চাহিদা বোঝার ক্ষমতা কমে যায়। যার কারণে শিশু কতটুকু খাবে তা শরীরের কতটুকু খাবার প্রয়োজন তার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্য অনেক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, শিশুকে পরিমাণে বেশি খাবার দিলে শিশু গড়ে ৩০ শতাংশ বেশি খাবার খায়।
শিশুকে পরিমাণে অনেক বেশি খাবার দেওয়া এবং সে যতটুকু খেতে চায় তার চেয়ে বেশি খেতে জোর করা শিশুর অতিরিক্ত খাওয়া এবং অতিরিক্ত ওজনের জন্য দায়ী।
জোর না করে যা করতে পারেন
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ সময়েই শিশুরা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে কখন তারা ক্ষুধার্ত অথবা কখন তাদের পেট ভরে গিয়েছে। তাই তাদেরকে বিশ্বাস করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস করুন তাদের যখন ক্ষুধা লাগবে তারা খাবে। এটা বিশ্বাস করলে আপনি শিশুকে খেতে জোর করার প্রয়োজন বোধ করবেন না। তাদের শরীরের যখন খাবারের দরকার হবে তারা নিজে থেকেই খেয়ে নেবে বা খেতে চাইবে। শিশুদের নতুন খাবার কিংবা তিতা খাবার না খেতে চাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। এসব ক্ষেত্রে শিশুকে জোর করবেন না। বরং, শিশুকে খাবারগুলো দিতে থাকুন এবং সে খেতে না চাইলে মেনে নিন। শিশুর এই খেতে না চাওয়াকে শিশুর বেড়ে ওঠার একটা স্বাভাবিক অংশ হিসেবে দেখুন। আপনি শিশুর খাওয়ার ব্যাপারে কেমন আচরণ করছেন তাই ঠিক করে দেয় এটা শিশুর জন্য একটা ভালো অভিজ্ঞতা হবে নাকি খারাপ।
১. লক্ষ্য করা: আপনার শিশু শেষ কখন নাস্তা অথবা পেট ভরার মতো কোনো পানীয় যেমন দুধ খেয়েছে? তার কি আসলেই ক্ষুধা লেগেছে? সে কি খুব ক্লান্ত? সে কি টেবিলে বসতে বা ভালো করে খেতে পারবেনা? আপনার শিশু কি অসুস্থ বলে তার ক্ষুধা লাগছেনা? একটা ডায়েরিতে আপনার শিশুর নাস্তা, পানীয় (ড্রিঙ্ক) , খাবার খাওয়ার এবং ঘুমের সময় এবং কতবার খাচ্ছে এবং ঘুমাচ্ছে তা নোট করুন। দেখুন তার রুটিনকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে তার খাবারের অভ্যাসকে আরো স্বাস্থ্যকর করা যায়।
২. তাদের মতো করে ভাবুন: ভেবে দেখার চেষ্টা করুন তো, আপনার কেমন লাগতো যদি আপনি ক্ষুধার্ত না থাকা সত্ত্বেও আপনাকে খেতে জোর করা হতো, কিংবা এমন কিছু জোর করে খাইয়ে দেওয়া হতো যেটা আসলে কোন খাবার তা আপনি জানেনই না? আপনার শিশুর মতো করে অনুভব করার চেষ্টা করলে কিংবা আপনার আচরণকে তাদের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন যে এভাবে খেতে জোর করলে শিশুর ভালো না হয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা ই বেশি থাকে। শিশু যখনই কোনো একটা খাবার খেতে চাইবেনা, সে কেন খেতে চাইছেনা তা তার দিক থেকে ভেবে দেখার চেষ্টা করুন।
৩. নিজের চাওয়াকে আলাদা রেখে ভাবুন: খাবার শিশুর জৈবিক চাহিদা পূরণ করে। তাই মনে রাখবেন, শিশুর খাওয়াদাওয়া তার জন্য আনন্দের হওয়া উচিত,আপনাকে সন্তুষ্ট করতে নয়। শিশুকে আপনার ঠিক করা পরিমাণ মতো খাবার খেতে বাধ্য না করে, এটা ভেবে খুশি হন যে আপনার শিশুর যতটুকু চাহিদা সে ততটুকু খাবার খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছে।
৪. তাদের পেটকে বিশ্বাস করুন: আমাদের ক্ষুধা লাগলে কিংবা পেট ভরে গেলে আমাদের শরীর খুব ভালোভাবেই তা জানান দেয়। কিন্তু শিশু খেতে না চাইলেও তাকে বারবার খেতে জোর করলে শরীরের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিতে সমস্যা হয়। যখন ক্ষুধা লাগবে তখন খাওয়া এবং যখন পেট ভরে যাবে তখন খাওয়া বন্ধ করা একটি খুব স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। তাই আপনার শিশুকে কখন তার ক্ষুধা লাগছে এবং কখন তার পেট ভরে গেছে মনে হচ্ছে তা প্রকাশ করতে উৎসাহ দিন।
৫. খাবারের পরিমাণ খেয়াল করুন: শিশুদের পেট বড়দের থেকে ছোট হয়। আপনি হয়তো এটা মাথায় না রেখেই শিশুকে বেশি পরিমাণে খাবার দিয়ে ফেলেন এবং আশা করেন শিশু খাবারটা খেয়ে শেষ করবে।এক্ষেত্রে একটা দারুণ টিপস হলো শিশুর হাতের তালুর সমান পরিমাণ খাবার। ধরুন, একটা কলা, শিশু কতটুকু খাবে? ও যদি ওর হাতের তালুর সমপরিমাণ কলা খায় সেটাই যথেষ্ট। ভাত কিংবা অন্য খাবার যেটা আরো ভারী সেটা আরো কম খেতে পারে।এই ছোট্ট বিষয়টি মাথায় রাখলেই শিশুর খাবারের পরিমাণ নিয়ে অযথা উদ্বেগ বা অতিরিক্ত প্রত্যাশা তৈরি হবে না।
এই লেখাটি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অ্যাস্টন ইউনিভার্সিটি ও লাফব্রা ইউনিভার্সিটির গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে।