দুধে এলার্জি এবং ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

দুধে এলার্জি, গরুর দুধ হজম করতে না পারা এবং ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স এর ব্যাপারে আপনি হয়ত অনেক শুনেছেন। এগুলো নিয়ে অনেক কথা হলেও গবেষকরা মনে করেন বেশিরভাগ শিশুরই এ সমস‍্যা থাকে না।

দুধে এলার্জি যতটা শোনা যায় তত বেশি হয় না

শিশু মানেই কান্নাকাটি করে, খিটখিটে হয়ে থাকে।অনেকেরই গ‍্যাস হয়। কিন্তু প্রথম সন্তান হওয়ার পর বেশিরভাগ মা-ই শিশুর খিটখিটে মেজাজ এবং কান্নাকাটির কারণ হিসেবে সন্দেহ করে থাকেন যে  শিশুর হয়তো গরুর দুধে এলার্জি আছে বা মায়ের বুকের দুধ হজম করতে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজন শিশুর এমন সমস্যার জন্য দুধকেই দায়ী করলে এ ধারণা পাকাপোক্ত হয়।

যেসব এলার্জি বাচ্চাদের মধ্যে সচরাচর পাওয়া যায় মিল্ক এলার্জি তার মধ্যে একটি হলেও,  বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ শিশু এই সমস্যায় আক্রান্ত। আমরা অনেকেই মিল্ক এলার্জি এবং ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স এর পার্থক্য স্পষ্ট জানিনা এবং দুটোকে আলাদা করতে পারিনা বলে এ বিষয়ে আরো বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

এই বিভ্রান্তি দূর করতেই এই লেখায় বাচ্চাদের মিল্ক এলার্জি, বুকের দুধ এবং ফরমুলা দুধের ইনটলারেন্স নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মিল্ক এলার্জি এবং ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের মধ্যে পার্থক্য কী

মিল্ক এলার্জি

বাচ্চার সত্যি মিল্ক এলার্জি থাকলে, শিশুর শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা গরুর দুধে থাকা প্রোটিন সহ্য করতে পারে না, ফলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেসব শিশু মায়ের বুকের দুধ খায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মায়ের খাওয়া ডেইরিজাতীয় খাবারে প্রতিক্রিয়া দেখায় কারণ গরুর দুধে থাকা প্রোটিন বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে পৌঁছায়। বাচ্চা ফরমুলা খেতে অভ্যস্ত হলে তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফরমুলায় থাকা গরুর দুধের প্রোটিনে খারাপভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।


মিল্ক ইনটলারেন্স

অন্যদিকে, মিল্ক ইনটলারেন্স গরুর দুধের প্রোটিন বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে না, বরং হজম প্রক্রিয়ার সমস্যার কারণে হয়।  মিল্ক ইনটলারেন্স থাকলে দুধ খাওয়ার কয়েক ঘন্টা বা কয়েকদিন পরেও বাচ্চার পাতলা পায়খানা হতে পারে এবং পায়খানার সাথে রক্তও আসতে পারে।

কনজেনিটাল ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স একটি বিপাকীয় অবস্থা (মেটাবলিক কন্ডিশন)  যা পাচনতন্ত্র বা হজম প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। ল্যাকটোজ হলো এক ধরনের সুগার যা ডেইরিজাতীয় খাবারে থাকে। 

ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স ছোট বাচ্চাদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায় । বিশেষত বড় বাচ্চা আর বড়দেরই এই সমস্যা থাকে। তবে খুব অল্পসংখ্যক বাচ্চা, যাদের এই সমস্যা আছে তাদেরকে ল্যাকটোজ খুব কম মাত্রায় বা একদমই নেই এমন ফরমুলা দুধ খাওয়ানোই ভালো।

 

শিশুকে ফরমুলা খাওয়ানোর সময় বেশ সতর্কতা পালন করতে হয়
আরো পড়ুন: ফরমুলা নিয়ে যা যা জানা দরকার
বাচ্চার দুধে এলার্জি থাকলে কী কী লক্ষণ দেখা যায়

রোগ প্রতিরোধের জন্য শরীর হিস্টামিনসহ আরো কিছু কেমিক্যাল নিঃসরণ করে যেগুলোর কারণে শরীরে এলার্জির লক্ষণগুলো দেখা যায়।

মিল্ক এলার্জিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো:

  • ছানা বমি
  • বমি
  • পেটে ব্যথা বা কলিকের লক্ষণ, যেমন অতিরিক্ত কান্না করা,  মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকা (বিশেষ করে খাওয়ার পর)
  • ডায়রিয়া
  • পায়খানার সাথে রক্ত
  • মুখে লাল দাগ হওয়া
  • ত্বকে খসখসে বা র‍্যাশ হওয়া
  • কাশি কিংবা নিশ্বাস নেয়ার সময় জোরে জোরে আওয়াজ করা
  • চোখে পানি জমা এবং নাক বন্ধ হয়ে থাকা
  • নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া অথবা চামড়ার রং কিছুটা নীলচে হয়ে যাওয়া 
  • মুখ আর গলা ফুলে যাওয়া
গরুর দুধ
আরো পড়ুন: গরুর দুধ বাচ্চাকে কিভাবে দিতে হয়
বাচ্চার ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকার লক্ষণ
  • পেটে গ্যাস জমে থাকে
  • ডায়রিয়া হয়
  • পেট ফেঁপে থাকে
  • খাবার হজম না হয়ে বের হয়ে আসে
  • মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, বেশি কান্নাকাটি করে 
  • ওজন ঠিকমতো বাড়ে না
বাচ্চার ওজন
বাচ্চার ওজন ঠিক আছে কিনা কিভাবে বুঝবো
মিল্ক এলার্জি কিভাবে শনাক্ত করা যায়

মিল্ক এলার্জি বা মিল্ক ইনটলারেন্সের লক্ষণ দেখলে শিশুকে ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার সাধারণত মিল্ক এলার্জি এবং মিল্ক ইনটলারেন্স দুটোর জন্যই চেক আপ করতে পারেন কিংবা বাচ্চার পায়খানার পরীক্ষা করতে পারেন। এছাড়া ত্বকের পরীক্ষা করানো লাগতে পারে, এবং পরিবারে আর কারো এলার্জি আছে কিনা এ ব্যাপারেও ডাক্তার আলোচনা করতে পারেন।

যদি ডাক্তার বাচ্চার মিল্ক এলার্জি বা মিল্ক ইনটলারেন্স আছে বলে সন্দেহ করেন, তাহলে বুকের দুধ খেতে অভ্যস্ত বাচ্চার মায়েদের ডেইরিজাতীয় খাবার বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।

বাচ্চা যদি ফরমুলা খেতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে ডাক্তাররা অন্য কোনো ফরমুলা খাইয়ে দেখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং এতে শিশুর অবস্থার উন্নতি হয় কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বলেন।

এক সপ্তাহ গরুর দুধ পুরোপুরি বন্ধ রাখার পর, নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাক্তার আবার আপনাকে গরুর দুধ খেতে বলতে পারেন। এতে করে বোঝা যাবে, গরুর দুধের কারণে বাচ্চার শরীরে প্রতিক্রিয়া হয় কিনা।

দুধে এলার্জির চিকিৎসা করার উপায়

আপনার বাচ্চা যদি পৃথিবীর সেই ২ থেকে ৩ শতাংশ বাচ্চাদের একজন হয় যাদের দুধে এলার্জি আছে- হতাশ হবেন না। বেশিরভাগ শিশুরই ৩ বছর বয়স হতে হতে দুধে এলার্জি ঠিক হয়ে যায়, কিছু বাচ্চার তো ১ বছর বয়সেরই মধ্যেই মিল্ক এলার্জি ভালো হয়ে যায়।

তবে  ঠিক হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণত ডাক্তারেরা নিচের পরামর্শগুলো দিয়ে থাকেন। 

বাচ্চা যদি ফরমুলা খায়: শিশু যে ফরমুলা খায় ডাক্তার তা বদলে ফেলার পরামর্শ দিতে পারেন। কারণ কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চার মিল্ক এলার্জি থাকলে তার সয় আর ছাগলের দুধেও এলার্জি থাকতে পারে। তাই ডাক্তাররা বাচ্চাকে হাইড্রোস্লেট প্রোটিন আছে এমন হাইপোএলার্জিক ফমুর্লা  খাওয়ানোর পরামর্শ দিতে পারেন। সহজে বললে, এই ধরনের ফমুর্লাতে দুধের প্রোটিন আগে থেকেই কিছুটা ভাঙা থাকে, ফলে এই দুধে বাচ্চার শরীরে এলার্জি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।

বাচ্চা সরাসরি বুকের দুধ বা পাম্প করে রাখা দুধ খেলে:  এক্ষেত্রে সাধারণত বাচ্চার এলার্জির কোনো উন্নতি হয় কিনা বোঝার জন্য ডাক্তাররা মাকে যেকোনো ধরনের ডেইরি জাতীয় খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেন। সদ‍্যজাত শিশুকে সামলানোর পাশাপাশি নিজের খাদ্যাভাসে এত বড় একটা পরিবর্তন আনা একটু কঠিন হবে, কিন্তু এই পরিবর্তনটা আনলে শিশুর সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। যদি আপনার খাদ্যাভাস থেকে দুধ জাতীয় সব খাবার বাদ দিতে হয় তবে ডেইরিজাতীয় খাবার বাদ দিয়েও কী করে আপনার শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান এর চাহিদা মেটানো যায় এ বিষয়ে  আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিন।

 

রেফারেন্স:
1. American Academy of Pediatrics, Lactose Intolerance in Infants & Children: Parent FAQs

2. American Academy of Pediatrics, Choosing a Baby Formula

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *