এ আর্টিকেলে যা থাকছে
অনেক শিশুরই মুখের প্রথম সচেতন বুলি ‘না’। বাবা মা সারাদিন এতবার ‘না না না’ বলেন যে শিশু সবার আগে এই নেতিবাচক শব্দটাই শেখে। শিশুর অযাচিত আচরণের সময় ‘না’ এর বদলে কী বলা যেতে পারে সেটা নিয়ে এ আর্টিকেলে আলোচনা করব।
যখন শিশু কোনো জিনিস ধরে আর আপনি পাশ থেকে চিৎকার করে বলেন, মুখে দিও না! আপনি ভালোর জন্যই বলেন। কিন্তু হতে পারে আপনি হয়তো না বুঝেই ওর মাথায় ধারণাটা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন যে সে জিনিসটা মুখে দিতে পারে।ওর হয়ত এটা মুখে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু এমন হতেই পারে যে আপনার বলা কথা থেকে সে শুধু বুঝলো “মুখে দিও!”
কেন শিশুকে সবসময় “না” বলবেন না
“না”, “করো না” কিংবা “করা উচিত নয়” এ শব্দগুলো বলতে আমরা খুব অভ্যস্ত। কিন্তু এ শব্দগুলো কম ব্যবহার করেও আপনি শিশুকে বোঝাতে পারেন তার কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়। “না” শব্দটা বললে শিশু বুঝতে পারে আপনি চান সে ঐ নির্দিষ্ট কাজটি না করুক। কিন্তু “না” শব্দটি কম ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হলো শিশুকে কী করা উচিত নয় সেটা না বুঝিয়ে কী করা উচিত সেটা বুঝিয়ে বলা।
শিশুকে বারবার ‘না’ বললে ‘না’ শব্দটি গুরুত্ব হারায়। অর্থাৎ একসময় শিশু আর নিষেধ মেনে চলে না। শিশু যেন নির্দেশনা মেনে চলে বা কথা শোনে সেজন্যই বারবার ‘না’ বলা থেকে বিরত থাকা উচিত।
যে কাজটি শিশু করলে আপনি বিরক্ত হন, সেটা যেন না করতে পারে সে ব্যবস্থা সবার আগে করুন। যেমন ধরুন, রান্নার চুলা ধরা বা ঘরের সুইচবোর্ড ধরা। শিশু যেন এসবের নাগাল না পায় সে ব্যবস্থা করুন। আর এর বদলে শিশু কী ধরতে পারে, তেমন জিনিস তার নাগালে রেখে দিন।
বারবার ‘না’ শুনলে শিশু মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগ্রহ, উদ্দীপনা, উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।অনেক শিশু দ্বিধা বা ভয়ে ভোগে। তাই ‘না’ কে এড়িয়ে চলাই উত্তম।
কিভাবে শিশুকে আরো কম "না" বলতে পারেন
ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করুন
শিশুর সাথে ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে কথা বললে শিশুর সমস্যা সমাধান এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা বাড়ে৷ শিশুরা যত ইতিবাচক কথা শুনবে তত তারা কী করতে পারবেনা সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে, তারা কী কী করতে পারবে সেসবে মনোযোগী হতে পারবে৷
খাবারটি ছুঁড়ে ফেলো না–না বলে বলুন, খাবারটি এখানে প্লেটের ওপরে রাখো।যে কোনো খাবার প্লেটের ওপরে রাখতে হয়। তারপরে এভাবে ধরে মুখে পুরে খাও। যদি খেতে ইচ্ছা না করে তাহলে প্লেটের এককোণায় এভাবে রেখে দাও। (করে দেখান)
আপনার কথা বলার ধরন পরিবর্তন করুন
“ ঠিক করে ধরো! ফেলে দিও না” বলার পরিবর্তে আপনি কথাটা এভাবে বলতে পারেন “গ্লাসের পানিটুকু যাতে পড়ে না যায়, তাই তুমি গ্লাসটি দুই হাতে শক্ত করে ধরেছো, এজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!”
তাকে বুঝিয়ে বলুন আপনি কী চাইছেন
গবেষণায় দেখা গেছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একটা বাক্যের কিছুমাত্র অংশ মন দিয়ে শোনে৷ মানে তারা পুরোটা শোনে না।শিশুর ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি সত্যি। শিশু কেমন আচরণ করুক আপনি চান না তা বললে, শিশু যে কাজ করা তার উচিত নয়, সেই কাজগুলোরই ধারণা পায়৷ তাই শিশুর কী করা উচিত নয় তার পরিবর্তে তার কী করা উচিত বা তার থেকে কেমন আচরণ আপনি আশা করছেন তা শিশুকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলুন।
শিশুর থেকে যেমন আচরণ আশা করেন সেটাই যতটুকু পারেন শিশুকে দেখান। যেমন: “কুকুর/ বেড়ালের লেজ ধরে টেনো না” না বলে তাকে দেখিয়ে দিয়ে বলুন “এই যে এইভাবে আদর করতে হয়” অথবা “খেলনাগুলো ছুঁড়ে ফেলোনা” না বলে তাকে দেখিয়ে দিয়ে বলতে পারেন “এইভাবে খেলনাগুলোকে গুছিয়ে রাখতে হয়”
আরো পড়ুন: শিশুকে কথা বলা শেখাবো কিভাবে
“না” শোনা যেন শিশুর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে না যায়
শিশু যদি “না” শব্দটি অনেকবার শোনে তবে সে একসময় তাকে কিছু করতে নিষেধ করা হলে তাতে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এইভাবে “না” শব্দটি তার কাছে এর অর্থই হারিয়ে ফেলে। সে শব্দটিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
শিশুর কাছে কারণ ব্যখ্যা করুন
আপনি শিশুর থেকে কোনো এক ধরণের আচরণ কেন আশা করছেন, তা শিশুকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বললে শিশু ধীরে ধীরে আরো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। যেমন শুধু “ঘরে ঢোকার আগে জুতো খুলে রাখো” না বলে “ঘরে ঢোকার আগে জুতো খুলে রাখলে ঘরের মেঝে পরিস্কার থাকে” বলতে পারেন।
তাদের অনুভূতির স্বীকৃতি দিন
যখন শিশু দোকানে গিয়ে কিছু কেনার জন্য বায়না করে তখন “না, এটা কিনে দেব না” না বলে আপনি বলতে পারেন “আমি বুঝতে পারছি খেলনাটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছে, তাই তুমি খেলনাটি কিনতে চাইছো৷ কিন্তু আমরা আজ এই খেলনাটি কিনছি না।”
ভিন্নভাবে বলুন
“না” বলার পরিবর্তে আপনি যা চাইছেন তা শিশুকে ঘুরিয়ে বলুন। যেমন “এভাবে কাজটা করোনা” না বলে বলুন “এসো দেখি আমরা কিভাবে আরো ভালো উপায়ে কাজটা করতে পারি!”
জরুরী অবস্থার জন্য “না” বাঁচিয়ে রাখুন
আপনি শিশুকে “না” শব্দটি কম বললে, যখন কোনো জরুরী অবস্থায় আপনি তাকে গুরুত্বের সাথে “না” বলবেন, তখন সে সেটা শুনবে৷ এসব ক্ষেত্রে, “থামো!” কিংবা “ওখানেই থাকো! নড়ো না!” এই শব্দগুলোও ব্যবহার করতে পারেন।
আমার অভিজ্ঞতা
এমিলের এক বছর বয়সের চেক আপে এমিলের ডাক্তার আমাদেরকে খুব জোরালোভাবে বলে দিয়েছিলেন বারবার যেন ওকে ‘না’ না বলি। এর বদলে হাত পা নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে ঘটনাটি বুঝিয়ে বলি। করতে গিয়ে বুঝলাম এটা বেশ কঠিন। কারণ মানা করাই আমাদের অভ্যাস।
ভাষা ব্যবহারের অভ্যাস বদলানো প্রথমে বেশ কঠিন মনে হতে পারে। তাই এভাবে কথা বলার জন্য অনেক অনুশীলন করতে হবে। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যশীল থাকবেন। শিশু পালনে পরিবারের অন্য যে সদস্যরা জড়িত তাদের সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন কেন ‘না’ বলাটা এড়িয়ে অন্যভাবে বলতে হবে। প্র্যাকটিস করলে আপনিও শিশুর সাথে ইতিবাচকভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ🥰