দিনে আপনার শিশুকে কতবার, কতক্ষণ করে ঘুম পাড়াবেন? কোন বয়সে গিয়ে বাচ্চা দিনের বেলা ঘুমানো বন্ধ করে দেবে? বাচ্চার ঘুমানোর সময় নিয়ে আপনার যা কিছু জানা প্রয়োজন তা আলোচনা করছি এই লেখায়।
বাচ্চা যত বড় হতে থাকে, তার ঘুমের চাহিদা কমতে থাকে। তবে দিনে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত শিশু দিনে সাধারণত ২ থেকে ৩ ঘন্টা ঘুমায়। সকালে একবার, দুপুরে খাওয়ার পর একবার। ১৮ মাসের চেয়ে বড় বাচ্চারা সারাদিনে একবারই লম্বা একটা ঘুম দেয় বিকালে।
বাচ্চার ঘুম নিয়ে বাবা মায়ের মনে যেসব প্রশ্ন থাকে, তার উত্তর দিতেই এই ঘুম বিষয়ক আর্টিকেল।
বয়সভেদে শিশুর ঘুম
যে কোনো অভ্যাস তৈরি করতেই রুটিন খুব উপকারি। দিনে ঘুম পাড়াতেও একটা নির্দিষ্ট রুটিন থাকলে সুবিধা হবে। তবে বয়সের পার্থক্যের কারণে রুটিন পরিবর্তন করতে হবে। কোন বয়সী শিশুর মোট কতক্ষণ ঘুম প্রয়োজন তার একটা গড় হিসাব হলো–
জন্মের পর থেকে ৩ মাস এই বয়সের বাচ্চাদের সাধারণত দিন রাত মিলে মোট ১৪ থেকে ১৭ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। এরা সাধারণত ১ থেকে দেড় ঘন্টা পরপর ঘুমায়। দিনের বেলা ৩০ মিনিট থেকে শুরু করে দুই ঘন্টা পর্যন্ত ঘুমায়।
৪ থেকে ১২ মাস এ বয়সে মোট ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা ঘুমানো দরকার। এই বয়সের বাচ্চারা আগের চেয়ে লম্বা সময় ঘুমায়। রাতের ঘুমটা আগের চেয়ে দীর্ঘ হয়। ৪ মাস বয়সে বাচ্চার দিনের বেলা ৪ বার ঘুম দরকার। বয়স ৬ মাস হলে দিনে দুইবার ঘুমায় – সকালে একবার, বিকালে একবার।
১ থেকে ২ বছর এই বয়সে বাচ্চা ১১ থেকে ১৪ ঘন্টা ঘুমায়। দেড় বছর বয়সের আগে সকালে ও বিকালে মোট দুইবার ঘুম প্রয়োজন। দেড় বছরের পর থেকে বাচ্চা সকাল ও বিকাল দুইবেলা না ঘুমিয়ে শুধু বিকালে একটানা একটা লম্বা ঘুম দিতে পারে।
৩ থেকে ৫ বছর এই বয়সে বাচ্চারা সাধারণত মোট ১০ থেকে ১৩ ঘন্টা ঘুমায়। ৩ থেকে ৪ বছরে বয়সে এসে কিছু শিশু দিনের বেলা ঘুমানো বন্ধ করে দেয়। তবে অনেক বাচ্চা আবার ৫ বছর পর্যন্ত বিকালের ঘুমটা ছাড়ে না।
৬ থেকে ১২ বছর ৬ বছরের পর থেকে বাচ্চার আর দিনে ঘুমানোর প্রয়োজন পড়ে না। এরচেয়ে বরং রাতে একটানা দীর্ঘ সময় ঘুমালেই বেশি উপকার হবে।
১২ থেকে ১৮ মাস বয়সী বাচ্চার ঘুমানোর রুটিন
এটা একটা মডেল বা আদর্শ হিসেব। প্রতিটি বাচ্চা আলাদা। সেই সঙ্গে পরিবারের রুটিনের ওপরে বাচ্চার রুটিন অনেকখানি নির্ভর করে।
সকাল ৭টা: সজাগ
সকাল ৯.৩০: ঘুম
বেলা ১১টা: সজাগ
দুপুর ২টা: খাবার খাওয়ার পর ঘুম
বিকাল ৩.৩০: সজাগ
সন্ধ্যা ৭.৩০/৮টা: রাতের লম্বা ঘুম
১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সী বাচ্চার ঘুমানোর রুটিন
এই বয়সে বাচ্চা সাধারণত সকালের ঘুমটা বাদ দিয়ে বিকালে একবার ঘুমায়। আপনার বাচ্চার বয়স ১৮ থেকে ২৪ মাস হলে নিচের রুটিনটা অনুসরণ করতে পারেন:
সকাল ৭টা: সজাগ
বেলা ১২.৩০: ঘুম
দুপুর ২.৩০/৩টা: সজাগ
সন্ধ্যা ৭.৩০/৮টা: রাতের লম্বা ঘুম
২ বছর বয়সী বাচ্চার দিনে কতক্ষণ ঘুমানো উচিত
সাধারণত ২ বছর বয়সী বাচ্চা দিনের বেলা ২ থেকে ৩ ঘন্টা ঘুমায়। এই বয়সে শিশু সকাল বিকাল দুইবার ঘুমাতে চায় না। বরং দুপুর-বিকালে টানা ঘুমাতে থাকে।
কখন আপনার বাচ্চাকে দিনে দুইবারের বদলে একবার ঘুমানোয় অভ্যস্ত করবেন?
লক্ষ্য করে দেখুন। দিনে বিছানায় শোয়ালে যদি বাচ্চা ছটফট করে, পুরোটা সময় শুয়ে শুয়ে খেলতে থাকে অথবা সরাসরি বলে “আমার ঘুম পাচ্ছে না’ তাহলে বুঝতে হবে দুইবারের বদলে একবার ঘুমালেই হবে।
তবে এই পরিবর্তনের জন্য বাচ্চাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে।প্রথম কয়েক সপ্তাহ টানা ৬ ঘন্টা জেগে থাকতে গিয়ে বাচ্চার মেজাজ একটু খিটখিটে হয়ে যেতে পারে।
এই সময় বাচ্চা দিনে একবার ঘুমালেও দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় চুপচাপ বসে থাকে এমন কোনো কাজ দিন। ১ থেকে ২ দুই ঘন্টা শিশুকে বিছানায় বই, রং অথবা পুতুল দিয়ে বসিয়ে রাখতে পারেন। এভাবে লম্বা সময় জেগে থাকায় বাচ্চার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়বে না।
এ ছাড়া দুপুরের খাবারটা একটু আগে খাইয়ে দিতে পারেন। এভাবে বাচ্চা চাইলে বিকালের ঘুমটা একটু আগেও দিতে পারবে।
তবে দুপুরের খাবারের আগেই যদি শিশু ঘুমিয়ে পড়ে, চিন্তা করবেন না। জেগে উঠলে ধীরেসুস্থে খাওয়াতে পারবেন।
রুটিনে হঠাৎ পরিবর্তন আসায় রাতের খাবারের সময় হতে হতে শিশুর মেজাজ অল্পতেই খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। তাই এই সময়টায় বাচ্চাকে একটু আগেই রাতের খাবার খাইয়ে নিলে ভালো। এতে আপনার শিশু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারবে।
তবে দিনে যদি বাচ্চাকে রুটিনের চেয়ে দেরিতে ঘুম পাড়ান তাহলে আবার রাতে ঘুমাতে দেরি করবে।
বাচ্চার দিনে ঘুম কেন দরকার
টডলার বা ১ থেকে ২ বছরের বাচ্চার দিনে সাধারণত ১১ থেকে ১৪ ঘন্টা ঘুমানো দরকার। রাতে একটানা এতক্ষণ ঘুমানো যায় না। তাই দিনে ভাগে ভাগে অল্প ঘুমিয়ে নেওয়া বাচ্চার শরীরের জন্য উপকারী।
১৮ মাসের কাছাকাছি বয়সে বেশিরভাগ বাচ্চাই দুপুরের আগে ঘুমানো বন্ধ করে দিয়ে বিকালে দীর্ঘ সময় ঘুমায়। তবে এই অভ্যাস হতে কিছু বাচ্চার ২ বছর সময় লাগে।
দিনে না ঘুমালে বাচ্চার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, চেঁচামেচি করে। এছাড়া ক্লান্ত হয়ে থাকার পাশাপাশি শিশুর ক্ষুধা কমে যায়। এতে দেখা যায় শিশু রাতেও শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না।
এ ছাড়া দিনে না ঘুমালে বাচ্চা সারাক্ষণ ছোটাছুটি করার শক্তি পায় না।
আমার বাচ্চা দিনে কেন ঘুমাতে চায় না
দিনের ঘুম বাচ্চার শরীরের জন্য উপকারি। তাই বলে সব বাচ্চাই যে নিজে নিজে দিনে ঘুমায় এমন কিন্তু না। শিশু দিনে ঘুমাতে না চাওয়া অথবা ঘুম পাড়াতে চাইলে কান্নাকাটি করা খুবই স্বাভাবিক। যেসব কারণে বাচ্চা দিনে ঘুমাতে চায় না সেগুলো হলো-
বাচ্চা বেশি ক্লান্ত খুব বেশি ক্লান্ত হলে বাচ্চার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। তখন দেখবেন আপনার বাচ্চাকে আদর করে ঘুম পাড়াতে চাইলেও ছটফট করবে। সাধারণত রাতে ভালো ঘুম না হলে বাচ্চা ক্লান্ত থাকে।
খেলার সুযোগ ছাড়তে চায় না যেসব বাচ্চাদের একটু বেশি ছোটাছুটি করার অভ্যাস, সাধারণত তারা দিনে ঘুমাতে চায় না। ঘুমিয়ে পড়লে দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা করতে পারবে না এই চিন্তায় ঘুম আসবে কিভাবে!
আপনি দূরে থাকলে ভয় পায় কাছের মানুষ দূরে থাকলে অস্থির হয়ে পড়াকে সেপারেশন এংজাইটি বলে। আপনার বাচ্চার যদি সেপারেশন এংজাইটি থাকে, রাতে-দিনে যখনই ঘুম পাড়াতে যান, বাচ্চা ঘুমাতে চাইবে না।
শরীর দিনে জেগে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে দিনে জেগে থাকার অভ্যাস হয়ে গেলে বাচ্চার শরীরই তাকে ঘুমাতে দেয় না৷ তাই আপনার শিশু চেষ্টা করলেও রাত হওয়ার আগে ঘুম আসে না।
দিনে শিশুকে যেভাবে ঘুম পাড়াবেন
দিনে ঘুমাতে না চাইলেও বাচ্চাকে কিভাবে ঘুম পাড়াবেন এ বিষয়ে নিচের পরামর্শগুলো কাজে লাগতে পারে–
ঠিক সময়ে ঘুম পাড়াবেন বাচ্চাকে দিনে ঘুম পাড়াতে হলে ঠিক সময়ে বিছানায় শোয়ানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত বাচ্চা অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ার আগেই তাকে শুইয়ে দিন। লক্ষ্য করুন বাচ্চা কখন একটু ঝিমিয়ে পড়ছে। সাধারণত দুপুরে খাওয়ার পর শিশুর চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসে। এই সময় আরামের একটা বিছানায় শুইয়ে দিলেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে।
তবে আপনার শিশুর মধ্যে যদি ঝিমানির লক্ষণ দেখা না যায়, তাহলে আগেরবার ঘুমানোর দুই থেকে তিন ঘন্টা পরে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করুন।
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম পাড়ান বাচ্চাকে কয়েকদিন একটা নির্দিষ্টি সময়ে ঘুম পাড়াতে পারলে একটা পর্যায়ে গিয়ে শরীর অভ্যস্ত হয়ে যাবে। দেখবেন প্রতিদিন ওই সময়ে বাচ্চা সহজেই ঘুমিয়ে পড়ছে।
দিনে ঘুমানোর রুটিন তৈরি করুন রাতে ঘুমানোর আগে যেমন বাচ্চাকে প্রতিদিন গল্প পড়ে শোনান, বা গুনগুন করে গান শোনান, গল্প বলেন–দিনেও এমন একটা রুটিন তৈরি করুন। এভাবে বাচ্চার শরীর, মন দিনেও স্থির অনুভূতি পেয়ে ঘুমাতে পারবে।
তবে বেশি করতে যাবেন না। ঘুম পাড়াতে গিয়ে লম্বা সময় ধরে গল্প পড়লে আবার দেখবেন ঘুমের সময়ই পার হয়ে গেছে।
ঘুম পাড়ানোর আগে বাচ্চাকে খাইয়ে নিন বাচ্চা যদি বিকালে ঘুমাতে না চায় তাহলে দুপুরের খাবারের পরপর ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করুন। আর দুপুরের আগে ঘুমাতে চাইলে অল্প কিছু খাইয়ে নিন। পেট ভরা থাকলে বাচ্চা ঘুমাতে বায়না করবে না। ঘুমও গভীর হবে।
যদি বেশ কিছুদিন চেষ্টা করে দেখেন কোনোভাবেই আপনার শিশুকে ঘুম পাড়াতে পারছেন না, তাহলে হয়তো বাচ্চার সকালের ঘুমটা বাদ দেওয়ার বয়স হয়ে গেছে।
আর দিনে দুইবারের বদলে একবার ঘুমানোর অভ্যাসে আসার পরিবর্তন সামলাতে বাচ্চার একটু সময় লাগতে পারে। এ সময় বাচ্চাকে একটু স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। এই পর্যায়ে এসে বাচ্চা রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারে। সার কথা হলো, পরিবর্তনটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাচ্চাকে একটু সময় দিন।
বাচ্চারা কখন দিনে ঘুমানো বন্ধ করে দেয়
অন্য অনেক বিষয়ের মতোই বড় হতে হতে বাচ্চার অভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আসে।
বয়স ৩ থেকে ৪ বছর হলেই বেশিরভাগ বাচ্চা দিনে ঘুমানো বন্ধ করে দেয়। তবে কিছু শিশু স্কুলে ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত এই অভ্যাস থেকে বের হতে পারে না।
বয়স ৩ বছর হওয়ার পর যদি দিনে ঘুম পাড়াতে চাইলে বাচ্চা উঠে যেতে চায় তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার শিশুর দিনে ঘুমানোর অভ্যাস ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় হয়ে গেছে।
তবে হুট করেই বাচ্চার দিনের ঘুম বন্ধ করে দেবেন না। শরীরের দরকার হলেও অনেক সময় বাচ্চা দিনে ঘুমাতে চায় না। ঘুম ঠিকমত না হলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে থাকবে। তাই যতদিন প্রয়োজন বাচ্চাকে দিনে ঘুম পাড়ান।
আর দিনের ঘুম ছাড়িয়ে নেওয়ার পরেও যদি বাচ্চার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে, কোনোকিছুতে মনোযোগ দিতে না চায় অথবা অস্থির আচরণ করে তাহলে আবার বিকালে ঘুম পাড়ানো শুরু করতে কোনো বাধা নেই।
শুধু লক্ষ্য রাখবেন শিশু যেন দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় শান্ত, স্থিরভাবে কাটায়। এক জায়গায় বসে রং করা, কিছু আঁকা বা পাজল মেলানোর মত খেলা দিয়ে তাকে শান্ত রাখুন।
রেফারেন্স:
- American Academy of Pediatrics, Healthy Sleep Habits: How Many Hours Does Your Child Need? Opens a new window, November 2020.
- Sleep Foundation, How Much Sleep Do Babies and Kids Need? Opens a new window, December 2021.
- KidsHealth From Nemours, Naps Opens a new window, June 2020.
- Journal of Clinical Sleep Medicine, Recommended Amount of Sleep for a Healthy Adult: A Joint Consensus Statement of the American Academy of Sleep Medicine and Sleep Research Society Opens a new window, June 2015.
- National Institutes of Health, National Library of Medicine, The Effects of Napping on Cognitive Function in Preschoolers Opens a new window, February 2011.
- National Institutes of Health National Library of Medicine, Spotlight on Daytime Napping During Early Childhood Opens a new window, March 2018.
- KidsHealth From Nemours, Sleep and Your 1- to 2-Year-Old Opens a new window, June 2019.
- Sleep Foundation, When Should Kids Stop Napping? Opens a new window, January 2021.
- Stanford Children’s Health, Infant Sleep Opens a new window, 2022.
- Stanford Children’s Health, Separation Anxiety Opens a new window, 2022.
- University of California Davis Health, Children’s Hospital, How to Help Babies, Toddlers Sleep Through the Night Opens a new window, 2022.