বাচ্চার দাঁত ক্ষয় কেন হয়

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

বাচ্চার দাঁত ক্ষয় রোগ বা ক‍্যাভিটি আমাদের দেশে খুবই সাধারণ ব‍্যাপার। এর পেছনে নিয়মিত ব্রাশ না করা যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই দায়ী বাচ্চাকে পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ানো। বাচ্চার দাঁতের সুরক্ষায় করণীয় বিষয় নিয়ে আমেরিকান ডেন্টাল অ‍্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ এই লেখাতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

বাচ্চার দাঁত ক্ষয় রোধে করণীয় কী

বাচ্চার প্রথম দাঁত ওঠার সময় থেকেই দাঁত ব্রাশ করানোর অভ‍্যাস করুন।বাচ্চাদের জন‍্য নিরাপদ বেবি টুথপেস্ট এবং নরম বেবি ব্রাশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এবং সকালের খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করার অ‍ভ‍্যাস করুন।  নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া– এই দুই অ‍ভ‍্যাস করলে ক‍্যাভিটি বা দাঁত ক্ষয় রোগ থেকে বাচ্চাকে মুক্ত রাখতে পারবেন। 

বাচ্চার দাঁত ভালো রাখার জন‍্য American Academy of Pediatric Dentistry এর  ৯টি পরামর্শ এখানে আলোচনা করা হল। কয়েকটি আমি আগে জানতামই না। আশা করি এ লেখাটি আপনার উপকারে আসবে। 

ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার

বাচ্চার দাঁত যেন শক্ত ও মজবুতভাবে বড় হয় এজন‍্য তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ফ্লোরাইডসহ অন্যান্য খনিজ (মিনারেল) এবং ভিটামিন সি এর মতো ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ান। এতে করে শিশুর দাঁত ও মাড়ি সুস্থ থাকবে।আমরা অনেকেই জানি না ভিটামিন সি বাচ্চার মাড়ি সবল সুস্থ রাখতে বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। ভিটামিন সি জাতীয় ফল টক হয় বলে অনেকেই সেটা এড়িয়ে যান।বাচ্চারাও ভিটামিন সি এর অভাব থেকে যেসব রোগ হয় সেসবে বেশি ভোগে। 

বাচ্চাকে টক দই কখন থেকে দেয়া যায়
আরো পড়ুন
অনেকক্ষণ ধরে চাবাতে হয় এরকম খাবার বাদ দিন

অনেকক্ষণ ধরে খাবার চাবানোকে ইংরেজিতে গ্রেইজিং (grazing) বলা হয়।মুড়ি, চানাচুর কিংবা চুইংগাম হলো এমন ধরনের খাবার যেগুলি অনেকক্ষণ ধরে চাবাতে হয়। বাচ্চার দাঁতের অ্যানামেল অর্থাৎ সাদা অংশ ক্ষয় হওয়ার পেছনে গ্রেইজিং অনেকটাই দায়ী। শিশু একটু পরপর বাদাম, বুট, মুড়ি চিবোতে থাকলে মুখের লালা দাঁতে জমে থাকা খাবারের অংশ পরিষ্কার করার সময় পায় না।

বাচ্চাকে নাশতায় তাজা ফল, মুচমুচে কোনো সবজি (বেগুন ভাজা বা বেগুনি) এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ দুধজাতীয় খাবার দিন যাতে বাচ্চার শক্তি বাড়ার পাশাপাশি দাঁতও সুরক্ষিত থাকে।

চিনিযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখুন

বাচ্চাকে একদমই চিনি ছাড়া খাবার খাওয়ানো প্রায় অসম্ভব। কারণ প‍্যাকেটের সব খাবারে চিনি থাকে। এমনকি পাউরুটিতেও। তবে চিনিযুক্ত খাবারের পরিমাণ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

বিশেষত রিফাইন্ড চিনি (বিস্কুট, কেক, পাউরুটিতে বেশি থাকে) ও আঠালো প্রাকৃতিক চিনি (শুকনো ফল/ড্রাইড ফ্রুটে এই চিনি থাকে) যেন শিশু বেশি না খায় এ ব্যাপারে নজর রাখুন।

আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিক ডেন্টিস্ট্রির মতে, এক বছরের আগে কোনো ধরনের চিনি, দুই বছরের আগে কোনো ধরনের অ‍্যাডেড সুগার দেয়া যাবে না। ৪ থেকে ৮ বছর বয়সী বাচ্চাদেরকে প্রতিদিন ১৬ গ্রামের বেশি চিনি খাওয়ানো উচিত না। 

কিভাবে এটা মেনে চলবেন ভাবছেন? বাচ্চাকে মিষ্টি খাবার যতটা সম্ভব কম খাওয়ান। দিনে সর্বোচ্চ দুইবার। এবং সময়ের খাবারের সময়ই খেতে দিন। নাশতার সময় মিষ্টি কিছু খেতে দেবেন না।

পানি ছাড়া অন্য পানীয় (জ‍্যুস/গামিজ) খাওয়াবেন না

শিশুকে পানির বদলে অন্য কোনো তরল খাবার যেন না খাওয়ানো হয় এ ব্যাপারে এএপি বেশ গুরুত্ব দেয়।এমনকি এক বছর পর থেকে ফরমুলা দুধের বদলে গরুর দুধ দিতে পরামর্শ দেয়া হয়। কারণ ফরমুলা দুধে যে প্রাকৃতিক চিনি ও অ্যাডেড সুগার থাকে, তা মুখের ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এসে অ্যাসিডে পরিণত হয়। এই অ্যাসিড দাঁতের অ্যানামেল অর্থাৎ ওপরের অংশে আক্রমণ করে ক্ষয় করে ফেলে।

বাচ্চাকে জ‍্যুস বা ফলের রস খাওয়াতে চাইলেও একদম পেট ভরিয়ে না খাইয়ে মাঝে মধ্যে একটু দিতে পারেন। চিনির পরিমাণ কমাতে জ‍্যুস একদমই বাদ দিতে পারলে ভালো। বাচ্চাকে বরং তাজা ফল খেতে দিন, যাতে আঁশ জাতীয় খাদ্য উপাদান থাকে। আর ফলের রস যদি খেতে দেনই, তাহলে সেটা যেন বেশি ঘন না হয়, অর্থাৎ পাতলা তরল হয়। বাচ্চাকে কোনো স্বাস্থ্যকর নাশতায় বা খাবারের সাথে ফলের রস দিন, খালি রস খাওয়াবেন না।বাজারে যেসব ফলের জ‍্যুস বিক্রি করা হয়, সেগুলি একেবারেই দিবেন না।

বাচ্চার জন্য আলাদা চামচ ব্যবহার করুন

বাচ্চার দাঁতে পোকা শুধু চিনিযুক্ত নাশতায় বা অনিয়মিত ব্রাশের অভ্যাসের কারণে হয় এমন না। বরং এর পেছনে দায়ী হলো streptococcus mutans নামক এক ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া মুখে জন্মে থাকা চিনি ও খাবারের অন্যান্য অংশ খেয়ে বেঁচে থাকে। আর অ্যাসিড উৎপন্ন করে দাঁতের ক্যালসিয়াম ভেঙে দাঁতে পোকা ধরায়। মুখের লালার সাহায্যে খুব সহজেই এটি বাবা-মা বা অন্য বাচ্চা থেকে শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে।

আপনার যদি দাঁত ক্ষয় রোগ থেকে থাকে, তাহলে আপনার বাচ্চার দাঁতও ক্যাভিটিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশংকা আছে। এই আশংকা কমাতে অবশ্যই বাচ্চার জন্য ব্যবহৃত টুথব্রাশ, খাবার চামচ ও অন্যান্য তৈজসপত্র আলাদা করে রাখুন।এছাড়া বাচ্চাকে আপনার মুখে আঙুল ঢোকাতে দেবেন না। আপনি নিজেও নিয়মিত ব্রাশ ও ফ্লস করবেন।

শিশুর দাঁত কখন উঠবে
আরো পড়ুন:শিশুর কোন দাঁত কখন উঠবে
বোতলের পরিবর্তে কাপে খাওয়া শেখান

আপনার বাচ্চা হয়তো ছোটবেলার ফিডার খাওয়ার অভ্যাস থেকে সরে আসতে চাইবে না৷ তাকে বোতলের পরিবর্তে কাপ বা গ্লাস থেকে থেকে খাওয়ার অভ্যাস করানো ভালো। বোতল আর সিপি কাপে দুধ বা জুস খেলে বাচ্চার মুখে ও দাঁতে খাবার বেশি পরিমাণে লাগে যার ফলে দাঁত ক্ষয় হতে পারে। 

আপনি হয়তো ভাবছেন বাচ্চা কাপ থেকে খেতে গেলে তরল খাবার ঢেলে দিবে, মেখে ফেলবে! এক্ষেত্রে শিশুকে ঢাকনাযুক্ত টডলার কাপে খেতে দিতে পারেন।  এই কাপগুলো যেকোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই কাজ করে। সাধারণ সিপিকাপের পরিবর্তে ছোট গ্লাস বা কাপে বাচ্চাদের পানি বা তরল খেতে দেয়ার পরামর্শ দেন দাঁতের চিকিৎসকরা কারণ- এই কাপ বাচ্চার মুখের পেশী গঠনেও সাহায্য করে।

আমরা ৮ মাস থেকে এমিলকে গ্লাসে পানি খাওয়া শিখিয়েছি।  

ঘুমানোর আগে ব্রাশ করান

ঘুমানোর আগে ব্রাশ করা খুবই দরকারি অভ‍্যাস। বাচ্চাকে রাতে বুকের দুধ বা ফিডার দিয়ে খাবার খাওয়ানো হলে, বাচ্চার দাঁত ব্রাশ করে দিন অথবা গরম পানিতে নরম কাপড় ভিজিয়ে সেটা দিয়ে দাঁতে জমে থাকা দুধ ভালো করে মুছে তারপরই তাকে ঘুম পাড়াবেন।

বাচ্চার দাঁতের যত্ন কিভাবে করা দরকার
আরো পড়ুন: কখন শিশুর দাঁত ব্রাশ শুরু করা উচিত
ফ্লোরাইড টুথপেস্ট ব্যবহার করুন

আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে বাচ্চার প্রথম দাঁত ওঠার পর থেকেই ব্রাশ করার জন্য ফ্লোরাইড টুথপেস্ট ব্যবহার করতে সমস্যা নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, একটি চালের দানার পরিমাণের চেয়ে বেশি টুথপেস্ট যেন ৩ বছরের চেয়ে ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা না হয়। বয়স তিন বছর পেরিয়ে গেলে স্থানীয় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে জেনে নিন আপনার ঘরে যে পানি আসে তাতে ফ্লোরাইড আছে কিনা। যদি না থাকে, বাচ্চাকে ফ্লোরাইড সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে পারেন। এছাড়া পানির ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না পারলে ডাক্তারের সাথেও পরামর্শ করতে পারেন।

তবে সতর্ক থাকবেন– বাচ্চার দাঁতের সুরক্ষায় ফ্লোরাইড কম হলে যেমন সমস্যা তেমনি বেশি হলেও সমস্যা। যদি ঘরের পানিতে ফ্লোরাইড থাকে, আবার বাচ্চাকে ফ্লোরাইডের সাপ্লিমেন্ট দেয়া হয়, একই সাথে ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশও করানো হয়, তাহলে শিশু ফ্লুওরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে। ফ্লুওরোসিস হলে দাঁতে বাজে দেখতে ছোপ পড়ে যায়। এমনকি সমস্যা গুরুতর হয়ে গেলে কিছু ক্ষেত্রে দাঁতে স্থায়ীভাবে ময়লার আস্তরণ পড়ে  দাঁত ক্ষয় করে ফেলে।

বাচ্চা ঘুমানোর সময় বোতল কাছে রাখবেন না

খাবারের বোতল মুখে নিয়ে রাখলে বাচ্চা শান্ত অনুভব করে সত্যি। তবুও, বাচ্চার বিছানায় বোতল রাখবেন না। কারণ বোতল কাছে পেলে শিশু ফিডারের নিপল মুখে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে যাতে করে বোতলের  তরল খাবার তার মুখে টপটপ করে পড়ে মুখে অ্যাসিড উৎপন্ন করে সদ্য গজানো দাঁতের ক্ষয় সাধন করতে পারে। বাচ্চার দাঁত এখনো উঠে না থাকলেও ঘুমানোর আগে বাচ্চাকে ফিডার মুখে দেয়ার অভ্যাস করানো উচিত না, কারণ পরবর্তীতে এই অভ্যাস ছাড়ানো আরো কঠিন হয়ে পড়বে।

 

রেফারেন্স: 

  1.  American Academy of Pediatrics, Good Oral Health Starts Early, November 2020.
  2. American Academy of Pediatrics, Baby’s Tooth: 7 Facts Parents Should Know, November 2020.
  3. American Academy of Pediatrics, How to Prevent Tooth Decay in Your Baby, September 2015.
  4. American Academy of Pediatrics, Pediatrics, Fluoride Use in Caries Prevention in the Primary Care Setting, August 2014.
  5. American Academy of Pediatric Dentistry, Policy on Dietary Recommendations for Infants, Children, and Adolescents, 2017.
  6. American Dental Association, Baby Teeth, 2022.

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *