শিশুর তোতলামি দূর করার উপায় কী

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

শিশুর তোতলামি শিশুর কথা বলা শেখার অংশ হতে পারে। অধিকাংশ বাচ্চাই ২ থেকে ৫ বছর বয়সে তোতলায় বা কথা বলার সময় শব্দ আটকে যায়। কখন এটা স্বাভাবিক আর কখন ব‍্যবস্থা নিতে হবে সেটা জানাতেই এ লেখা।

শিশুর তোতলামির সমস্যা কিভাবে বোঝা যায়

শিশু যত বড় হতে থাকে, তাদের বকবকও বাড়তে থাকে। কথা বলার শুরুতে কিছু শব্দ বলতে তাদের কষ্ট হয়। এই পর্যায়ে বাবা-মায়েরা শিশুর কথা বলতে পারা নিয়ে চিন্তিত হতে যেতে পারেন। শিশুর কথা বলতে গিয়ে আটকে যাওয়া কী আসলে স্বাভাবিক নাকি তোতলামি, কিভাবে সেটা বুঝবেন, আর কিভাবে তাকে স্পষ্ট কথা বলতে সাহায‍্য করবেন– জেনে নিন এ নিয়ে স্পিচ-ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজিস্টদের পরামর্শ।

শিশুর তোতলামি কখন স্বাভাবিক

কিছুটা থেমে থেমে কথা বলাটা ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। বিশ্বের প্রায় ৫ শতাংশ শিশুই শুরুতে কথা বলতে গিয়ে আটকায়। আড়াই থেকে ৫ বছর বয়সী বাচ্চারা কথা বলা শুরু করার সময় এই সমস্যায় পড়ে। এমনকি কিছুদিন ঠিকঠাক কথা বলার পরে হঠাৎ যদি শিশুর কথা আটকাতে শুরু করে, ভয় পাওয়ার কারণ নেই। বেশিরভাগ সময়ই বাচ্চা খুব বেশি খুশি থাকলে বা ক্লান্ত থাকলে এমন হয়। মাঝেমাঝে কোনো কারণ ছাড়াই এই বয়সের বাচ্চারা কথা বলতে গিয়ে আটকাতে পারে।   

শিশু কথা বলার নিয়ম শিখছে

এ বয়সে শিশু অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক নতুন শব্দ শিখতে শুরু করে। কথা বলার কঠিন নিয়মগুলোও সে এই বয়সেই শেখে। এই নিয়মগুলো শেখার পরই সে সহজ কথার পাশাপাশি তুলনামূলক জটিল বাক্যগুলোও উচ্চারণ করতে পারে। যেমন ‘আম্মু ভাত’ এর বদলে ‘আম্মু আমাকে নীল প্লেটে ভাত দাও’ বলতে শেখে। 

এছাড়া স্পষ্টভাবে কঠিন বাক্য উচ্চারণ করার সময় ঠোঁট,থুতনি ও শ্বাসনালী একসাথে কাজে লাগাতে হয়। তাই শুরুতে বাচ্চাদের এসব শিখতে গিয়ে একটু ভুল করাটা বা আটকানোটা খুব স্বাভাবিক। 

শিশুর তোতলামির সমস্যা কিভাবে বোঝা যায়

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কিছুদিন পর বাচ্চা কথা বলতে গিয়ে আর আটকাচ্ছে না। তবে কিছু শিশুর কথা বলার সমস্যাটা রয়ে যায় এবং কিছুদিন পর তোতলামির সমস্যাটা স্পষ্ট হয়। যত তাড়াতাড়ি তোতলামির সমস‍্যা নির্ণয় করা যায় তত তাড়াতাড়ি প্রতিকারের ব‍্যবস্থা বা চিকিৎসার ব‍্যবস্থা সম্ভব হয়। তাই এটা বোঝা খুব দরকার যে শিশুর তোতলামি আর স্বাভাবিক কথা জড়তার পার্থক‍্য কী। 

নিচের তালিকা আপনাকে এটা বুঝতে সাহায‍্য করবে।  

 

স্বাভাবিক

তোতলামি

  • একই বাক্য বারবার বলে(ও আমার খেলনা – ও আমার খেলনা দিচ্ছেনা আম্মু) 
  • একই শব্দ বারবার বলে (কিন্তু-কিন্তু-কিন্তু আমি লাল বলটা চাই)

একই শব্দের অংশ বারবার বলে ( ওই যে একটা বা-বা-বা-বা-বাবু, খে–খে–খে–খেলনা)

কথার মাঝখানে ‘মমমম..’, ‘আ-আ-আ’ এই ধরনের শব্দ করে। 

উচ্চারণের সময় লম্বা টান পড়ে (শশশশশশশশীত লাগছে)

কথা বলার সময় শিশুর মধ্যে কোনো ধরনের চাপ লক্ষ্য করা যায় না

কথা বলতে গিয়ে আটকে যায় (কোনো শব্দ বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেনা),  বলার সময় শারীরিক চাপ পড়ে 

কথার সময় অন্য কোনো সমস্যা হয় না

কথা বলার সময় চোখ পিটপিট করে, হাত নাড়তে থাকে ও বারবার গলা পরিস্কার করতে থাকে

কথা বলতে গিয়ে শিশু বিরক্ত হয়ে পড়ে না

কথা বলার সময় বিরক্তি দেখায়

পরিবারের আর কারো তোতলামি নেই

পরিবারের কারো তোতলামির সমস্যা আছে

৬ মাসের বেশি থাকে না 

৬ মাসের বেশি সময় থাকে

​আপনার শিশু যদি কথা বলার সময় প্রথম শব্দটা থেমে থেমে উচ্চারণ করে অথবা কথার মাঝখানে নির্দিষ্ট কোনো শব্দ উচ্চারণ করার সময় থেমে থেমে যায় তাহলে বুঝতে হবে শিশু আসলেই তোতলাচ্ছে। 

শিশুর তোতলামি থাকলে লক্ষ্য করবেন “কককক-খন খেলতে যাবো আমি” অথবা “ঐ দেখো একটা বাবাবাবাবাবাবা-বু” এভাবে কথা বলছে। 

এছাড়া যেসব শিশুদের তোতলামি থাকে, তাদের কিছু অভ্যাস তৈরি হয় যেমন- চোখ পিটপিট করা, মুখ খিঁচিয়ে রাখা, একপাশে তাকিয়ে থাকা এবং কথা বলার সময় চোখের দিকে না তাকানো।

আরো পড়ুন: বাচ্চার স্পিচ ডিলে আছে কিনা কিভাবে বুঝবো
শিশুর তোতলামি কেন হয়

নানা কারণে শিশুর তোতলামি দেখা দেয়। যে বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ–

  • পারিবারিক ইতিহাস পরিবারের অন্য কারো তোতলামি আছে কিনা এটার ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে শিশুর তোতলামির সমস্যা হবে নাকি না।  
  • লিঙ্গ মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুদের তোতলামি হওয়ার আশংকা দ্বিগুণ থাকে। প্রাইমারি স্কুলের ছেলেরা সমবয়সী মেয়েদের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকে। 
  • বয়স ৪ বছর বয়সে এসে শিশুর কথা বলার সমস্যা তৈরি হলে সেটা তোতলামিতে পরিণত হওয়ার আশংকা  বেশি থাকে। তবে ৪ বছরের কম বয়সে এ সমস্যা হলে তা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।  
  • অন্য কোনো স্পিচ বা ল‍্যাঙ্গুয়েজ ডিসঅর্ডার থাকলে শিশুর তোতলামির সমস্যা তৈরি হতে পারে।
শিশুর তোতলামি সারাতে যার সাহায্য নেবেন

আপনার বাচ্চার কথা বলা নিয়ে দুশ্চিন্তা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার যদি ঠিক মনে করেন, তাহলে কথা বলা ও ভাষার একটা পুরো পরীক্ষা করাতে পারেন। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্যে শিশুর কথা বলার সমস্যা কি দীর্ঘস্থায়ী তোতলামি নাকি সাময়িক সমস্যা তা বুঝতে পারবেন। 

এ বিষয়ে দক্ষ চিকিৎসকদের স্পিচ-ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজিস্ট বলা হয়। তারা সাধারণত শিশুর কথা বলার সাবলীলতা পরীক্ষা করে করণীয় সমন্ধে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। 

শিশুর তোতলামি কিভাবে দূর করা যায়

প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করার আগের বয়সেই শিশুর তোতলামি ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শিশুর তোতলামির চিকিৎসায় প্রধান দুইটি পদ্ধতি হলো– 

পরোক্ষ চিকিৎসা 

এ পদ্ধতিতে ডাক্তার শিশুর তোতলামির চিকিৎসা করতে পারিবারিকভাবে যে ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন সে বিষয়ে বাবা-মাকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বাবা-মায়েরা নিজেদের কথা বলার ধরন পাল্টে শিশুর তোতলামি কমিয়ে আনতে পারেন এই পদ্ধতিতে।  কিছু ক্ষেত্রে শিশু পুরোপুরি সেরেও যেতে পারে। 

অটিজম নির্ণয় পরীক্ষা
আরো পড়ুন: বাচ্চার অটিজমের লক্ষণগুলি কী

প্রত্যক্ষ চিকিৎসা

এই পদ্ধতিতে ডাক্তার সরাসরি শিশুর চিকিৎসা করেন। তিনি শিশুদেরকে আলাদা করে অথবা একসাথে কয়েকজনকে কথা বলার বিভিন্ন নিয়ম শিখিয়ে দেন। এতে করে কথা বলার সময় শিশুর মানসিক চাপ কমে, এবং সে সাবলীলভাবে কথা বলতে শেখে। এ ছাড়া এই পদ্ধতিতে ডাক্তার শিশুকে সাধারণভাবে কথা বলা ও তোতলামির মধ্যে পার্থক্য বুঝিয়ে দেন। 

সাত বছর বয়সের পর শিশুর তোতলামি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তবে এই বয়সেও তোতলামির চিকিৎসার মাধ্যমে শিশু কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে শেখে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তোতলামির কারণে শিশুকে অন্য বাচ্চারা ক্ষেপায়। এই ধরনের পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসা কাজে দেয়। তাই বয়স বেড়ে গেলেও চিকিৎসা নিলে শিশু তোতলামি ও এর প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। 

শিশুর তোতলামি সারাতে বাবা মায়ের প্রতি পরামর্শ

কথা বলার সময় শিশুকে বেশি চাপ দেবেন না

 কথা বলার সময় বিভিন্ন উপায়ে শিশুর ওপর চাপ কমানো যায়। বাচ্চাকে “আজ স্কুলে কী করলে বাবা?” এই ধরনের প্রশ্ন না করে বরং বলতে পারেন

 “ আজ স্কুলে গিয়ে খুব খেলাধুলা করেছো! খুব মজা পেয়েছো তাই না?” 

এতে বাচ্চার ওপর চাপ কমে। এ ছাড়া শিশুর তোতলামি শুরু হয় এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা থেকে বিরত থাকুন। যেমন–তাকে নার্ভাস করে তোলে এমন প্রশ্ন করা বা কাজ করা।  

তোতলামির বিষয়ে সরাসরি কথা বলুন

তোতলামির বিষয়টা বোঝার বয়স হলে শিশুর সাথে এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলুন। তোতলামিকে ওর কাছে খারাপভাবে উপস্থাপন করবেন না। শিশুকে জানান, একটু ভেঙে ভেঙে কথা বললেও কোনো সমস্যা নেই। আর শিশু যদি তোতলামির বিষয়টা ধরতে না পারে তাহলে ডাক্তার দেখানোর আগ পর্যন্ত তাকে এই ব্যাপারে কিছু না বলাই ভালো। 

ধৈর্য‍্য চর্চা করুন

শিশুকে কথা বলার সময় দিন। কথা বলার সময় তাকে তাড়া দেবন না, মাঝপথে থামিয়ে দেবেন না। আবার “ধীরে ধীরে বলো” অথবা “কী বলতে চাও সেটা চিন্তা করে তারপর বলো” এই ধরনের কথা বললে শিশুর তোতলামির ক্ষেত্রে খুব একটা ভালো প্রভাব পড়ে না। 

নিজে নিয়ম মেনে কথা বলুন

কিভাবে কথা বলতে হবে এই বিষয়ে শিশুকে বুঝিয়ে সাধারণত লাভ হয় না। তবে নিজেরা কথা বলার সময় কিছু নিয়ম মেনে চলতে পারেন। যেমন- নিজেরা ধীরেসুস্থে কথা বলা, কথার মাঝখানে একটু থামা এবং তাড়াহুড়া করে কথা না বলা।

অভিজ্ঞ কারো সাহায্য নিন

কম বয়সেই শিশুর তোতলামির জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভালো। এতে শিশুর তোতলামি সহজে সারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই যখনই বুঝতে পারবেন আপনার শিশুর তোতলামির বৈশিষ্ট‍্য দেখা দিচ্ছে, ডাক্তার দেখান। 

নিজের ওপর ভরসা রাখুন

একবার পরীক্ষা করেও যদি মনে হয় আপনার শিশুর তোতলামির সমস্যা নিয়ে ঠিকঠাক ফলাফল পাওয়া যায়নি, তাহলে আবার পরীক্ষা করান। প্রয়োজনে ডাক্তারের সাথে আলাদাভাবে শিশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এক কথায় বলতে গেলে নিজের ওপর ভরসা রাখুন। 



 

রেফারেন্স:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *