১৯ থেকে ২১ মাস বয়সে বাচ্চার আচরণগত গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটে থাকে। এ সময় সে যোগাযোগ দক্ষতা, ভাষা দক্ষতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় অতিক্রম করে। শিশু মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শের সাথে আমার অভিজ্ঞতা উদাহরণ যোগ করে এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
এ বয়সী শিশুর সাথে কিভাবে খেলবো, কিভাবে কথা বলব কিংবা রাগ হলে কিভাবে সামলাবো তা নিয়ে অনেক বাবা-মাই জানতে চান। তাদের জন্য এ ১০টি টিপস!
১. সীমিত সুযোগ দেওয়া
বাচ্চার আচরণ এ সময় অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কম সুযোগ দিয়ে। বেশিরভাগ সময় দুইটি জিনিসের মধ্যে একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দিন।
যেমন: ‘আমরা এখন বাইরে যাব। তুমি কি প্যান্ট আগে পরবে নাকি শার্ট আগে পরবে?’ ‘এখন তুমি কোন বইটা পড়বে? বিড়ালের বই নাকি ট্রেনের?” ও যেটা বেছে নেয় সেটা করতে দিন। এভাবে ও নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাববে। এবং স্বাস্থ্যকর উপায়ে মতামত জানানো শিখবে।
২. ছোট ছোট কাজ দেওয়া
খেয়াল করে দেখবেন ১ বছরের পর থেকেই শিশু ধীরে ধীরে সহজ নির্দেশনা বুঝতে পারে। যেমন- এদিকে আসো। উপরে দেখো।
তখন থেকেই ওকে ছোট ছোট কাজ দিন। যেমন: জুতাটা বক্সে রেখে আসো। জামাটা আলনায় ঝুলিয়ে রাখো। আলুটা ঝুড়ি থেকে আনো। ও যে শুধু খুশি হবে তাই নয়, এটা ওর ভাষা দক্ষতা ও জীবনদক্ষতা তৈরির সুবর্ণ সুযোগ। ওর আচরণেও পরিবর্তন আসবে।
৩. ইন্টারেস্টিং শব্দ বলা
এ বয়সের বাচ্চারা অনেক জটিল শব্দও বুঝে ফেলে (আপনি হয়ত কল্পনাও করতে পারবেন না)। আপনি যেভাবে কথা বলেন সেভাবেই বলবেন, চেষ্টা করবেন নতুন নতুন শব্দ ও কিভাবে শব্দটি ব্যবহার হয় সেটি ওকে বুঝিয়ে দিতে। যেমন: “ধরো তুমি একটা মিঁয়াও, ম্যাঁও ম্যাঁও করে ডাকো, কল্পনা করো তো তুমি মিঁয়াও!” গল্পের বই পড়ার সময় আমি সচেতন ভাবে ‘’কল্পনা” শব্দটি ব্যবহার করলাম। যাতে ও মজাও পায়, শেখেও।
৪. বাচ্চাকে খেয়াল করুন
বাচ্চা কী ধরতে চাইছে, কী করতে চাইছে, কিসের দিকে তাকাচ্ছে—খেয়াল করুন। তাহলে আপনি ওর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে বা বুঝতে পারবেন। আপনি নিজেও সে জিনিসটি নিয়ে কথা বলুন। খেলুন। এটা কিন্তু সহজ না! এর জন্য আপনার বাচ্চার দিকে বেশ মনোযোগ দিতে হবে।
আমি যখন খেয়াল করি এমিল নিজে নিজে জুতা পরতে চাচ্ছে। তখন আমি ওকে সাহায্য করি। পরিয়ে দিয়ে নয়। অন্যভাবে। জুতাগুলো ওর হাতের নাগালে রাখি। এমন জুতা দিয়েছি যেটা পরা সহজ। ও যখন নিজে পরতে চায়, ওকে ডিস্টার্ব না করে শক্ত কিছুর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করাই বা হাতে টেবিলের খুঁটি ধরিয়ে দেই। এতে ও নিজেই পরতে পারবে। আবার পড়ে ব্যথা পাবার আশঙ্কাও কম।
৫. শেয়ার করা শেখান অন্যভাবে
এ বয়সী বাচ্চারা এখনো অন্যের সাথে শেয়ার করা বোঝে না। এমন আচরণ আপনার জন্য খুব পীড়াদায়ক বা বিব্রতকর হতে পারে। কিন্তু ২১ মাসেও বাচ্চা শেয়ার শেখার মত বয়সে আসে না। কারণ ওর এখনো আরেকজনের মন বোঝার মত যোগ্যতা হয়নি। ওকে এখন শেখাতে পারেন কখন ওর পালা, কখন আরেকজনের পালা। দোলনায় চড়ার পরে আরেকজনের পালা কিংবা কোনো খেলনা দিয়ে খেলার পরে বুঝিয়ে বলুন, এতক্ষণ তোমার সময় ছিলো। এখন ওর খেলার পালা।
৬. ধীরে বন্ধু ধীরে
তরতর করে সিড়ি দিয়ে নামছেন কিন্তু বাচ্চা মাঝপথে মাকড়সা দেখে থেমে গেছে। ওকে টানাটানি করবেন না। অপেক্ষা করুন।আপনার কাছ থেকেই ও ধৈর্য্য, স্থৈর্য্য এবং সহিষ্ণু আচরণ শিখবে। আপনার হয়ত এক পৃষ্ঠা পড়া শেষ। কিন্তু ও পাতা উল্টাচ্ছেই না। অপেক্ষা করুন। ওকে সময় দিন। যখনই পারেন, ওর গতিকে গুরুত্ব দিন। সবসময় পারবেন না এটাই স্বাভাবিক। বেড়াতে যাওয়ার সময় তাড়াতাড়ি রেডি না হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু বাজারে যাওয়ার সময় দ্রুত জুতা মোজা না পরলে তো মুশকিলই!
৭. শেখার/ভুল করার সুযোগ দিন
এটা খুব খুব জরুরি। আমরা আমাদের বাচ্চার জন্য সবকিছু করতে চাই। সবকিছু করার মধ্যে ওকে শেখার সুযোগটাও দিতে হবে। ড্রয়ারটা খুলে নিজের জামা বের করতে দিন। মগ দিয়ে নিজের গায়ে পানি ঢালতে দিন। মোজা খুলতে, হাত ধুতে, চুল আঁচড়াতে দিন। (আমি দিচ্ছি)। কখনোই প্রথমবার বাচ্চা এগুলো ঠিকভাবে করতে পারে না। কিন্তু ঠিকভাবে করার চেয়ে নিজে নিজে শেখাটা অনেক বেশি জরুরি।
৮. অনুভূতির নাম শেখান
শুধু খারাপ বা ভালো নয়, এ বয়সে আপনি তার নানারকম মুড, আচরণ দেখবেন। কখনো জেদি, কখনো নাকি কান্না, কখনো আহ্লাদী, কখনো চরম মেজাজ খারাপ—এমন নানা রকম সময়ে আপনি কী শব্দ বলছেন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ও যখন জেদ করে মাথা ফ্লোরে ঠুকে দিচ্ছে (এমিল প্রায়ই দেয়) তখন চেঁচাবেন না। বলবেন না, বেয়াদব কিংবা জেদী!
আমি বলি, এমিল বাজারে এত মজা করছিল, এত ‘আনন্দ’ করছিলো যে বাসায় আসতে ওর ইচ্ছা করেনি। এখন বাসায় এসে ওর খুব ‘ক্ষোভ’ হচ্ছে। খেলতে না পেরে ‘আফসোস’ লাগছে। আবার যখন বাজারে যাবে তখন আবার ‘আনন্দ’ হবে। এখন বাসায় যেসব জিনিস আছে, ‘আনন্দের’, ‘মজার’, ‘রঙিন’ আমরা সেগুলো দিয়ে খেলি।
৯. ময়লা/ভুল করতে দিন
ময়লা না করলে কিন্তু সে শিখতে পারবে না। ময়লা করতে দিয়ে আমি এমিলকে ১৮ মাসের মধ্যে যা শিখিয়েছি: কমলা, রসুন, পেঁয়াজ, বাদামের খোসা ছাড়ানো, নিজের হাতে খাওয়া, নিজের হাতে নিজের গায়ে লোশন দেয়া। এ প্রতিটি কাজ সে শিখেছে কিন্তু অনেক এলোমেলো, ভুল আর ময়লা করে। খাবার মাথায় লাগানো, আসবাবপত্রে লাগানো, লোশন সবখানে লাগানো বা প্যান্টের ওপর লাগানো—এ সবই করেছে। এবং আমরা করতে দিয়েছি। বিশেষ করে খাওয়া শেখানোর জন্য ময়লা করা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
১০. যখন ওকে সময় দিবেন, ওকেই সময় দিবেন
আপনি আপনার বাচ্চার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আপনি যখন ওকে সময় দেবেন, চেষ্টা করবেন সেটা যেন ওকেই দেয়া হয়। (সবসময় এটা সম্ভব নয়)। ওর সাথে কথা বলার সময় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। ওর সাথে খেলার সময় মোবাইল দূরে রেখে ওর সাথেই খেলুন। ওকে গোসল করানোর সময় ফোনে কথা না বলে ওকে পানির সায়েন্স বলুন। মন প্রাণ ও শরীর দিয়ে থাকা যাকে বলে, বাচ্চাকে ২৪ ঘণ্টার কমপক্ষে ১০ মিনিট এভাবে সময় দিন।