যে কোনো ঋতুতেই নবজাতকের যত্ন নেওয়া বেশ ঝক্কির ব্যাপার। শীতের সময় শিশুকে যত্নে রাখা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। শীতকালের ঠাণ্ডা আবহাওয়া, ঠাণ্ডা বাতাস, রোগ-জীবাণু নবজাতক শিশুর বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাচ্চাকে পুরো শীতকাল জুড়ে কিভাবে ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও ঠাণ্ডা লাগা থেকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখা যায় তা নিয়ে আমেরিকার ডাক্তারদের ৭ টি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এ লেখাতে।
আমেরিকার সব অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে বাংলাদেশের সব এলাকার আবহাওয়ার মিল না থাকলেও এ লেখাটি আপনাকে বেসিক কিছু বিষয় বুঝতে সাহায্য করবে। যেমন, ত্বকে কোন লোশন দেবেন, শিশুকে কতবার গোসল করাবেন, শীতে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কিভাবে বাড়ানো যায় ইত্যাদি।
শীতে ত্বক শুস্ক হতে দেওয়া যাবে না
নবজাতকের ত্বকের ব্যারিয়ার বা ‘স্কিন ব্যারিয়ার’ বড়দের চেয়ে পাতলা ও দুর্বল হয়।
‘স্কিন ব্যারিয়ার’ হলো একটি আস্তরণ যা আমাদের ত্বক সুরক্ষিত রাখে, ত্বকের ময়েশ্চার এবং পুষ্টি ধরে রাখতে সাহায্য করে। ‘স্কিন ব্যারিয়ার’ দুর্বল হওয়ার কারণে শীতের ঠাণ্ডা, শুকনো ও স্বল্প আদ্রতার আবহাওয়ায় নবজাতকের ত্বক শুস্ক হয়ে যাওয়া, ফেটে যাওয়া এবং চুলকানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
০-৩ মাসের বাচ্চা বা নবজাতকের কোমল ত্বক সুরক্ষিত রাখতে বাচ্চাকে তিনদিনে শুধুমাত্র একবার গোসল করানো উচিত, কারণ পানিও বাচ্চার ত্বক শুস্ক করে ফেলে। ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রার পানিতে বাচ্চাকে ৫ মিনিট রেখেই গোসল শেষ করা উচিত। বাংলায় এ তাপমাত্রাকে আমরা কুসুম গরম পানি বলি।
৩ মাস থেকে ১ বছর বয়সী বাচ্চারা ১০ মিনিট পর্যন্ত গোসল করতে পারে, কিন্তু এর বেশি একেবারেই না।পানির তাপমাত্রা কমে যাবার আগেই বাচ্চাকে উঠিয়ে ফেলুন বা গরম পানি যোগ করুন।
গোসল শেষে বাচ্চাকে আলতো করে মুছে নিয়ে পুরো শরীরে গন্ধহীন ময়েশ্চারাইজার মেখে দিন। ঘন, অয়েন্টমেন্ট এর মত ময়েশ্চারাইজার ক্রিম বা লোশন ভালো কাজ করে। দিনে কয়েকবার ময়েশ্চারাইজার মাখতে হবে।
বাচ্চার ত্বকের ধরণ বুঝে বেবি অয়েল, অয়েল বেইজড ক্রিম বা লোশনও দিনে কয়েকবার ব্যবহার করতে পারেন। এ সময় পেট্রোলিয়াম জেলি (ভ্যাসলিন, আকুয়াফোর কিংবা মেরিল) শিশুর ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। বিশেষ করে শিশুকে ডায়পার পরানোর আগে ওই জায়গাতে ভালো করে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগান। এটি ডায়পার র্যাশ থেকে শিশুকে রক্ষা করে।
শীতে বাচ্চাকে অতিরিক্ত গরম জামা পরানো উচিত না
নবজাতক শিশুকে ঘুমের সময় উষ্ণ ও নিরাপদ রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, আপনি যতটুকু গরম জামাকাপড় পরে আছেন, শিশুকে তারচেয়ে শুধু এক লেয়ার বেশি পরানো (ডায়পার লেয়ারের মধ্যে পড়ে না)।
সুতির বা মসলিনের জামার ওপর ওজনে হালকা সোয়াডল কম্বল জড়িয়ে দিলে শিশু উষ্ণ থাকে।
শিশুকে সিন্থেটিক কাপড় কিংবা জার্সি কাপড়ের জামা পরানো উচিত না কারণ এই কাপড়গুলো দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে না যার ফলে বাচ্চার অনেক বেশি গরম লাগতে পারে।
শিশুর ঘুমানোর জায়গা থেকে অন্য খোলা কম্বল বা কাঁথা সরিয়ে ফেলতে হবে।
৮ মাসের বড় বাচ্চা সারাক্ষণই অনেক দৌড়ঝাপ করে বা শারীরিক কসরত করে। যার ফলে তাদের পোশাক বড়দের চেয়ে কমও হতে পারে। এ বয়সী বাচ্চাদের পোশাক এমন রাখা উচিত যেন সব জায়গা ঢাকা থাকে কিন্তু কোনোভাবেই সে ঘেমে না যায়।
বাচ্চার শীত লাগছে না গরম লাগছে কিভাবে বুঝবেন
বাচ্চার যেন বেশি শীত না লাগে বা বেশি গরম না লাগে তা নিশ্চিত করতে সবসময় শিশুর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। বাচ্চার কান এবং ঘাড় ছুঁয়ে দেখুন। শিশুর কান যদি লাল এবং গরম হয়ে থাকে এবং তার ঘাড় ঘেমে থাকলে বুঝতে হবে শিশুর বেশি গরম লাগছে।
সেক্ষেত্রে এক লেয়ার গরম জামাকাপড় খুলে ফেলুন, শিশুকে বুকের দুধ বা ফরমুলা খাওয়ান এবং হালকা উষ্ণ পানি দিয়ে তাকে স্পঞ্জ করুন। এতেও অবস্থার উন্নতি না হলে শিশুর ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
শিশুর বেশি ঠাণ্ডা লাগছে কি না বুঝতে তার পিঠ, পেট এবং বুকে হাত রেখে দেখুন এ জায়গাগুলো ঠাণ্ডা কিনা। ঠাণ্ডা হলে শিশুকে আরেক লেয়ার গরম জামাকাপড় পরান।
যদি মনে হয় শিশু বেশি ঠাণ্ডা হয়ে আছে, বা তার খুব বেশি ঠাণ্ডা লাগছে, সেক্ষেত্রে একটা গরম পরিস্কার কাপড় দিয়ে তার ঠাণ্ডা কান, নাক ও ঠোঁটে ভাপ দিন। তারপর শিশুকে মুছে দিয়ে, সোয়াডল করে, উষ্ণ বুকের দুধ বা ফরমুলা খাওয়ান। অবস্থার উন্নতি না হলে শিশুর ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
তাপমাত্রা বেশি বাড়িয়ে দেওয়া উচিত না
এটা শীতের দেশের জন্য প্রযোজ্য। বাড়িতে থার্মোস্ট্যাট ব্যবহার করলে, তাপমাত্রা ৬৮ থেকে ৭২ ডিগ্রী ফারেনহাইট এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত, এর বেশি নয়।
বাচ্চাকে উষ্ণ রাখতে তাপমাত্রা বেশি বাড়িয়ে রাখলে শিশুর ত্বক শুস্ক হয়ে যেতে পারে এবং বেশি গরম লাগার কারণে বাচ্চার অস্বস্তি হয়ে ঘুমের অসুবিধা হতে পারে। যাদের বাড়িতে হিটার চলে তাদের অবশ্যই হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা উচিত। বিশেষ করে বাচ্চা যেখানে ঘুমায় তার পাশে মাথার কাছে হিউমিডিফায়ার রাখুন।
শীতে শিশুকে নিয়ে বাইরে বের হোন
নবজাতকের শরীরে তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত ফ্যাট থাকে না, বা আমরা যেমন কাঁপার মাধ্যমে শরীর গরম করি, নবজাতক শিশু তাও করতে পারে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পুরো শীতকাল জুড়ে আপনাকে এবং আপনার শিশুকে ঘরের ভেতরে থাকতে হবে।
বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে বের হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ এ একটি গবেষণায় দেখা গেছে বাচ্চাকে অন্তত ২০ মিনিট প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া তার নিজের সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। এছাড়াও প্রাকৃতিক আলোতে সময় কাটালে শিশুর ঘুম ভালো হয়। শিশুকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিচের নিয়মগুলো মানতে পারেন–
- তাপমাত্রা মেপে দেখুন। বাইরে যদি খুব বেশি ঠাণ্ডা হয়, সেক্ষেত্রে শিশুর বাইরে থাকার সময় কমিয়ে দিন, যেমন বের হয়ে চট করে একবার হেঁটে আবার গাড়ি বা ঘরের উষ্ণতায় ফিরে আসা।
- গরম জামাকাপড় পরান। নবজাতকের শরীর উষ্ণ রাখতে তাদের বাতাস চলাচল করতে পারে এমন কাপড়ের গরম জামাকাপড় যেমন পুরো হাতার সুতির জামা, নরম প্যান্ট, মোজা, এবং সোয়েটার পরানো যায়। বাচ্চার বেশি গরম লাগলে এক লেয়ার জামাকাপড় কমিয়ে ফেলতে হবে। আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস এর মতে, আপনি যতটুকু গরম জামা পরে আছেন, বাচ্চাকে তার চেয়ে এক লেয়ার বেশি পরানো সবচেয়ে ভালো। শিশুর কান, হাত এবং পায়ের পাতা ভালোমতো ঢেকে রাখতে হবে।
- কম্বল ব্যবহার করুন। বাচ্চাকে স্ট্রলারে নিয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় তাকে কম্বল দিয়ে জড়িয়ে রাখুন।
- বাচ্চাকে ক্যারিয়ারে নিন। শিশুকে কোলে বা ক্যারিয়ারে নিলে আপনার শরীরের উষ্ণতা বাচ্চার শরীর গরম রাখে, যার কারণে সাধারণত একটা বাড়তি সোয়েটারের দরকার হয় না। শুধু খেয়াল রাখবেন শিশুর মাথা এবং পা যেন গরম থাকে। শিশুর দিকে লক্ষ্য রাখুন যেন তার মাথা আপনার বা তার নিজের বুকের সাথে চাপ না খায়। (বাচ্চার ঘাড় এবং চিবুক সোজা করে রাখতে হবে।)
জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করুন
শিশুকে জীবাণু সংক্রমণ থেকে দূরে রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো অসুস্থ মানুষ থেকে দূরে রাখা। বড় শিশুদের জন্য ঠাণ্ডা লাগা তেমন কোনো বড় ব্যাপার না, কিন্তু নবজাতকের ঠাণ্ডা লেগে খুব দ্রুত বড় ধরণের অসুখ যেমন ব্রঙ্কিওলাইটিস বা নিওমোনিয়া হয়ে যেতে পারে। তিন মাসের ছোট শিশুর মধ্যে অসুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখামাত্র ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলার মাধ্যমে শীতে শিশুকে ঠাণ্ডা লাগা থেকে রক্ষা করতে পারেন
- সম্ভব হলে বুকের দুধ খাওয়ান। বুকের দুধ নবজাতকের শরীরকে ইনফেকশান প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে শুরু করতে সাহায্য করে। বুকের দুধে এন্টিবডি, প্রোটিন, ফ্যাট, সুগার এবং শ্বেত রক্তকণিকা থাকে যা ইনফেকশানের সাথে যুদ্ধ করে। বুকের দুধের সাথে অল্প পরিমাণ ফরমুলাও সাহায্য করতে পারে।
- হাত ধুতে হবে। নিজে বারবার হাত ধুবেন এবং বাসায় কেউ এলে তাকেও হাত ধুতে বলুন। বাসার ছোট সদস্যদের হাত ধুতে শেখান।
- ভিড় এড়িয়ে চলুন। শীতের সময় বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে বের হলে ভিড় আছে এমন কোথাও যাবেন না, কারণ ভিড়ের মধ্যে হাঁচি, কাশির মাধ্যমে জীবাণু ছড়াতে পারে।
- ভ্যাক্সিন নিন। শিশুর কাছাকাছি বড় এবং ছোট মানুষ যারা থাকে তাদের প্রয়োজনমতো ফ্লু শট, ভ্যাক্সিন ইত্যাদি নেওয়া আছে কিনা নিশ্চিত করুন।
- বাসায় বাইরের মানুষের আসা-যাওয়া কম রাখার চেষ্টা করুন। বাসায় নবজাতক থাকলে কাছের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয় ছাড়া বেশি অতিথি না আসাই ভালো। নবজাতক যেন বড় বাচ্চাদের সংস্পর্শে কম আসে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
সলিড খাবার খায় এমন শিশুকে কমলালেবুর রস, লেবুর রস ও ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ান। এতে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়বে।মনে রাখবেন, কোনো ফল বা খাবার থেকে বাচ্চার ঠাণ্ডার অসুখ হয় না। কলা, কমলা, লাউ, টমেটো কিংবা শীতের শাক সবজি পুষ্টিগুণে ভরপুর।
গাড়িতে বা ‘কার সিট’ এ শিশুকে যেভাবে রাখবেন
শিশুকে কার সিট এ বসানোর সময়, তার কান, হাত ও পায়ের পাতা ঢাকা গরম কাপড় খুলে ফেলতে হবে। আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস এর মতে কার সিট এর হার্নেস এর নীচে মোটা কোট পরে থাকা উচিত না। শিশু যা-ই পরে থাকুক না কেন, কার সিট হার্নেস এর স্ট্র্যাপ যদি চিমটি দিয়ে ধরা যায়, তাহলে বুঝতে হবে হার্নেস আরও টাইট করতে হবে যাতে তা শিশুর বুকের সাথে ভালোভাবে আটকে থাকে। শিশুকে কার সিট এ ঠিক করে বসানোর পর তার শরীরের নীচের অংশের ওপর একটা হালকা কম্বল দিয়ে দিন। গাড়ির ভেতরের আবহাওয়া একটু গরম হয়ে উঠলে কম্বলটা সরিয়ে ফেলুন যেন শিশুর গরম না লাগে।